নারী শ্রমিকদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন
রাজধানীর মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন আসমা। নেশাগ্রস্ত বেকার স্বামী, তিন সন্তান ও এক ননদের ভরণ-পোষণের সমস্ত ভার তার একার কাঁধে বিধায় গত ৯ বছর ধরে এখানে কাজ করেন তিনি। ভোরবেলা উঠে ঘরের কাজ আর রান্নাবান্না শেষ করে ৮ টায় কারখানায় যায় আর ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টার মতো বেজে যায়। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর যে টাকা আয় হয় তাতে ঘরভাড়া দেয়ার পরেই খাবার কেনার জন্যই টান পড়ে যায়। কাজ করতে করতে একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে গেলে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা যায়, রেখা অ্যানিমিয়ায় বা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকার আরেক নারী শ্রমিক মারিয়া। দুই সন্তান রেখে স্বামী আরেকটি বিয়ে করে চলে গেছে বছর পাঁচেক আগে। সামাজিকতার বেড়াজালে আটকে আবারো বিয়ে হয় মারিয়ার। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে বাসায় ফিরলেই শুরু হয় স্বামী-শাশুড়ির সাথে অকথ্য ভাষায় ঝগড়া। এমনকি রেগে গিয়ে স্বামী জয়নাল বেধড়ক মারধর করে মারিয়াকে।
শুধু আসমা কিংবা মারিয়া নয়, বাংলাদেশে প্রায় অধিকাংশ নারী গার্মেন্টস কর্মীদের প্রাত্যহিক গল্প অনেকটা এরকমই। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, পোশাক শিল্পের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের এর ৬৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৬ লাখই নারী। যার মধ্যে ৮০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের বার্ষিক আয় ৩ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। ১০ বছর আগেও যেখানে পোশাক রফতানি থেকে আসত ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে শিল্পের ধারাবাহিক ব্যাপ্তি ঘটলেও শিল্পের সঙ্গে জড়িত নারী শ্রমিকদের ভাগ্য ততোটায় সংকোচিত হচ্ছে। রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টি ছাড়াও মানসিক বিষন্নতায় ভুগছেন তারা।
এ শিল্পের নারী শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)বলছে ৮০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। ঢাকা ও ময়মনসিংহের চারটি কারখানার ২৬০০ শ্রমিকদের ওপর চালানো গবেষণায় আইসিডিডিআরবি দেখিয়েছে, ১৮-৪৯ বছর বয়সী ওই নারী শ্রমিকদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
আইসিডিডিআরবি'র গবেষণার ফল বলছে, শুধু রক্তস্বল্পতাই নয়, অপুষ্টিজনিত অন্যান্য শারীরিক জটিলতায়ও ভুগছেন নারী পোশাক শ্রমিকরা। কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতাসহ শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে উৎপাদনশীলতায় এর প্রভাব পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তস্বল্পতার একাধিক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খাদ্যে আয়রনের অভাব, কৃমি, রক্তক্ষরণ, মাতৃদুগ্ধ পান করানো ও পেপটিক আলসার। জটিল রোগ ছাড়া একজন মানুষের এসব কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। নারী পোশাক কর্মীদের এই রক্তস্বল্পতা উৎপাদনশীলতায় প্রভাব ফেলে।
তবে এ বিষয়ে কী বলছেন পোশাক কারখানার মালিকরা? বৃহৎ এ শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকের পুষ্টি নিশ্চিতে শিল্পমালিকরা কি পদক্ষেপ নিয়েছেন বা নিবেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বিডিমর্নিংকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না এ সমস্যা কেবল পোশাক শিল্পের। দেশের সর্বত্রই পুষ্টিহীনতা রয়েছে। বরঞ্চ এ শিল্পে জরিত নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো আছেন।‘
নারী শ্রমিকদের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর দোষ চাপিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের অভ্যাস সহজে পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে এক সময় কর্মীদের দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হতো। এখন তারা খাবার না নিয়ে টাকা নিতে চায়।‘
পোশাক কর্মীদের সংগঠনের নেতারা মনে করছেন, বাংলাদেশে বর্তমান বাজারে কর্মীদের বেতন খুবই কম। যেখানে বেতনের অল্প টাকায় সংসারই চলে না, সেখানে পুষ্টিকর খাবার দুঃস্বপ্ন।
গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আইসিডিডিআর,বির সহকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুত্তাকিনা হোসেন বিডিমর্নিংকে বলেন, 'নারীরা নিজেদের ঘর সামলে বাইরে কাজ করতে আসা এর মধ্যেই নিজের সমস্তকিছু বিসর্জন দিয়ে বসে রয়েছে। ভোরবেলা আজানের শব্দে চোখ খোলার পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত দায়িত্বের ভার নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তার উপর একজন নারী হওয়ার অপরাধে তাকে ভুগতে হয় নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে। সব মিলিয়ে এই রক্তস্বল্পতা কিংবা পুষ্টিহীনতা বিষয়টি খুবই ছোট্ট বিষয় তাদের কাছে। কখনো কখনো এটি কোনো বিষয়ই না।'
'আমাদের গবেষণায় অংশ নেয়া শ্রমিকদের কারখানায় অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সময়ই তারা পারিবারিক সমস্যার কথা বলছেন। প্রকৃত সমস্যা সম্পর্কে অবগত না হওয়ায় দীর্ঘদিনেও অবস্থার উন্নতি হয় না।' বলে মন্তব্য করেন মুত্তাকিনা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিকদের পুষ্টির মান উন্নয়নে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন) ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ২০১৭ সালের জুনে শেষ হওয়া প্রকল্পটিতে গার্মেন্টসে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল ও আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট বিতরণ এবং গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির দেয়া দুপুরের খাবারের মান উন্নয়নসহ পুষ্টিবিষয়ক আচরণ পরিবর্তনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গার্মেন্ট শ্রমিকদের পুষ্টির মান উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্পটির অবদান বাড়ানোর লক্ষ্যে পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি সম্প্রসারণের জন্য ‘স্ট্রেনদেনিং ওয়ার্কার্স অ্যাকসেস টু পার্টিনেন্ট নিউট্রিশন অপরচুনিটিজ (স্বপ্ন)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে জিএআইএন।
সম্প্রতি প্রকল্পটির উদ্বোধনকালে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিতে শ্রমিকদের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও সুস্থতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে শ্রমিকদের আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি মালিক-শ্রমিকদের মাথায় রাখতে হবে। আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বল্প খরচে কীভাবে তাদের পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা যায়, সেটি ভাবতে হবে।
পুষ্টিহীনতা নিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজও করতে হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের। ওভারটাইম বা অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা নিয়ে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ শ্রমিক ১২ ঘণ্টা কাজ করে। ১০ ঘণ্টা কাজ করে ২৩ শতাংশ শ্রমিক। অতিরিক্ত সময় কাজে নিয়োজিত থাকার অন্যতম কারণ দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থা।
এই রক্তশূন্য ও অপুষ্ট নারীদের ওপর ভর করে দিন-দিন ব্যাপ্তি পাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ পোশাক শিল্প। এই পুষ্টিহীনতা নিয়েও অতিরিক্ত সময় কাজও করে যাচ্ছে নারী পোশাক কর্মীরা। ২০১৭ সালে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলার, ২০১৫ সাল শেষে আয় ছিল ২ হাজার ৮০৯ কোটি ডলার ও ২০১৪ সালে ২ হাজার ৫৪৯ কোটি ডলার।
শুধু অপুষ্টি কিংবা রক্তশূন্যতা নয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ও অপর্যাপ্ত মজুরি পোশাক শিল্পের উন্নতিতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন অনেকেই। দেশের ৯৭.৫ ভাগ কারখানায় কোন ট্রেড ইউনিয়ন নেই। যেগুলা আছে, তারা কার্যত দুর্বল অথবা অকার্যকর।
'কাঙ্ক্ষিত মজুরি না পাওয়ায় প্রয়োজন অনুযায়ী গোটা পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে হিমশিম খেতে হয় শ্রমিকদের। বেশ অনেকটা চাপের মধ্যেই থাকতে হয় তাদের। যার ফলে নিজেদের স্বাস্থ নিয়ে তেমন ভাবেন না। পুষ্টির প্রতি মনোযোগ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা তাদের জন্য। আর এভাবেই পুষ্টিহীনতা নিয়েই দিনের পর দিন কাজ করে যায় তারা।' বলে জানান গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার।
তবে একটু আশার আলো হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা ধরে খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। খসড়ায় ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল মজুরি ধার্য করা হয়েছে। বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ৩৫০ এবং খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা। সব মিলিয়ে মোট মজুরি দাঁড়ায় ৮ হাজার টাকা। ২০১৩ সালের নিম্নতম মোট মজুরি ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা।
১৯৯৬ সালে পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে তা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা ও ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা ছিল। সবশেষ ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের আগস্টে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নারী এবং পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ৯৩ ভাগ শ্রমিক কারখানায় যৌন হয়রানির শিকার হয় না বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
পোশাক শিল্পে নারী কর্মীদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সঠিক সময়ে নির্ধারিত মজুরি প্রদান বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে পারে বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদগণ।