‘পদ্মারে তোর তুফান দেইখা পরান কাঁপে ডরে, ফেইলা আমায় মারিসনা তোর সর্বনাশা ঝড়ে।’ লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল আলীমের পদ্মা নদী নিয়ে ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’ গান এখনও পদ্মা পাড়ের মানুষের মুখে মুখে। প্রমত্তা পদ্মা, ভয়ংকর পদ্মা, প্রলয়ংকরী পদ্মা যেন সর্বনাশা হয়ে উঠেছে।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
এই পদ্মাকে কেন্দ্রে করেই যাদের জীবন- জীবিকা চলতো সেই পদ্মাই তার করালগ্রাসে এখন সবকিছুই নিজের গর্ভে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে তার রূপ।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
পদ্মার সেই ভয়ংকর রূপের শিকার হচ্ছে শরীয়তপুরের নড়িয়া অঞ্চলের পদ্মার পাড়ের কয়েকশ পরিবার। পদ্মার আকস্মিক গতিপথ পরিবর্তনের ফলে শুরু হয়েছে প্রবল ভাঙন। একের পর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, আবাদি জমি, বাজার, হাসপাতাল, সরকারি স্থাপনাসহ সবকিছু।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
বিলাসবহুল বাড়ি থেকে শুরু করে মসজিদ-মাদ্রাসা সবকিছুই গিলে খাচ্ছে পদ্মা। পদ্মার বুকে টেনে নিয়ে গেছে নড়িয়ার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে নড়িয়াসহ পাঁচটি উপজেলার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেন সার্ভিসেসের হিসেবে, গত সাত বছরে নড়িয়ার প্রায় ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীতে ডুবে গেছে। এর মধ্যে গত জুলাই থেকে ভেঙেছে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
নড়িয়াবাসী এর আগে পদ্মার ভয়াবহতা দেখলেও এবার সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর রূপ দেখলো। এখানকার মানুষের কাছে অকল্পনীয় হলো ২০০ বছরের পুরোনো মুলফতগঞ্জ বাজারও ভাঙনের কবলে।যেখানকার দেড় হাজারের বেশি দোকানপাট নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে কয়েক হাজার মানুষ।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
একদিকে নিজেদের বসতভিটা, বাড়ি ঘর হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে এখানকার মানুষ। অন্যদিকে নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নিজেদের শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে নড়িয়ার কয়েক হাজার মানুষের রাত্রী যাপন চলছে খোলা আকাশের নীচে।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
ইতিমধ্যে নড়ীয়ার ব্রিজ-কালভার্ট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে ৫ কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে প্রথম এই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়। এখন যেখানে পদ্মা নদী তারও পাঁচ ছয় কিলোমিটার ভেতরে একসময় আবাদী জমি ছিল। পদ্মার ভাঙনে যা এখন নদীগর্ভে বিলিন হয়ে একাকার হয়ে গেছে।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
গত ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের নদী ভাঙন সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়ে আসছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস। এই সংস্থাটি তাদের বাৎসরিক প্রতিবেদনে অন্তত চার মাস আগে এই এলাকায় এমন ভাঙনের কথা উল্লেখ করেছিলো।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
এদিকে গত বছর থেকে তীব্রভাবে নদী ভাঙা শুরু হলে এই বছর জানুয়ারি মাসের দুই তারিখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরেশ্বর থেকে কুন্ডেস্বর পর্যন্ত প্রায় নয় কিলোমিটার জায়গা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ এবং নদীর মধ্যেখানে একটি চ্যানেল কেটে পানি অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য একটি প্রকল্প পাশ করেন।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
কিন্তু গেল নয় মাসেও সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখন নড়িয়ায় এই ভয়াবহ অবস্থা বলে জানা গেছে।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষার পানি না কমা পর্যন্ত ভাঙন থামবে না৷ বর্ষার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড অনেক সময় বালির বস্তা দিয়ে থাকলেও সেটা ভাঙনরোধে সবসময় কাজ করে এমন না। তবে অনেক সময় সাহায্য করে। আগামী বছর শুকনার সময় মূল কাজটি করার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল
তবে এই সময়ে পদ্মা কী তার করালগ্রাস থামাবে? নাকি মানচিত্র থেকে হারিয়ে পদ্মায় বিলিন হয়ে যাবে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা!