Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

পুলিশকে ফাঁকি দিতেই হেলমেটের নামে ‘ক্যাপ’ কেনার হিড়িক!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৪:৪৫ AM
আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৫:৪২ AM

bdmorning Image Preview
ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল


রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়। শনিবার বিকাল ৩ টা। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশের ৩ কর্মকর্তা। সাথে রয়েছেন কয়েকজন ট্রাফিক সদস্য। দেড় ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে তাদের বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে মোটরসাইকেলের জন্য। সিগনাল দিয়ে রাখলেও অনেক মোটরসাইকেল চালক সিগনাল অমান্য করেই পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে উদ্যাত হয়।

এ সময় লক্ষ্য করা যায়, সিগনালে অপেক্ষমাণ বেশিরভাগ মোটরসাইকেলে চালক ছাড়াও আছে হেলমেট পরিহিত একজন করে যাত্রী। আপাতত দৃশ্যে ট্রাফিক আইন মেনে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের হেলমেট ব্যবহার দৃশ্যমান হলেও এটার পিছনে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মকতার সাথে কথা বলে মিললো তার সত্যতা। তাঁরাও জানান, হেলমেট ব্যবহার ছাড়া এখন মোটরসাইকেল পাওয়ায় যায় না। যে দুই একটা পাওয়া যাচ্ছে সেটাকে মামলার আওতায় আনছেন তাঁরা।

পুলিশ কর্মকর্তাদের এই বক্তব্য আপাতত প্রশান্তিদায়ক। কারণ নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের পর অন্তত মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের মধ্যে হেলমেট ব্যবহারের প্রবণতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু নতুন আগ্রহ তৈরি হলো আরোহীর ব্যবহার করা হেলমেট দেখে। সেই আগ্রহ মেটাতেই গন্তব্য মোটরসাইকেল হেলমেট ও পার্টস বিক্রির বড় পাইকারী ও খুচরা বাজার রাজধানীর বংশালের মুকিম বাজারে।

সেখানে গিয়ে দেখা গেল খুচরা হেলমেট বিক্রির দোকানগুলোতে কম দামের হেলমেট কেনার হিড়িক পড়েছে। এখানকার পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে হেলমেট বিক্রি বিষয়ে জানতে চাইলে হেলমেট বিক্রি বাড়ার আসল কারণ জানান তাার।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের পর সরকার ও পরিবহন মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। সড়কের নৈরাজ্য, দুর্ঘটনা কমাতে শক্ত অবস্থান নেয় ট্রাফিক পুলিশও। হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের ব্যাপারে এককাট্টা হয়ে সড়কে নামে ট্রাফিক পুলিশ। তারই অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) হেলমেট না থাকলে মোটরসাইকেলের তেল না দেয়ার জন্য রাজধানীর পাম্প মালিকদের নির্দেশ দেন। হেলমেট বিক্রির পিছনে এসবই কারণ বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল

মোটরসাইকেলের চালক আরোহীদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হেলমেট ব্যবহার আবশ্যক করা হলেও এখন নিজেদের নিরাপত্তাকে থোড়াই কেয়ার করেই দেদারছে কিনছেন কম দামের হেলমেট। যেগুলোকে বিক্রেতারা বলছেন ক্যাপ। নিরাপত্তার কথা না ভেবেই হেলমেটের নামে ক্যাপ কেনার উদ্দেশ্যে একটাই, পুলিশকে ফাঁকি দেয়া ও মামলা থেকে রক্ষা পাওয়া।

শনিবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেলমেট বিক্রির অন্তত ২০ টি দোকানে গিয়ে ক্রেতাদের সমাগম দেখা গেল। তবে এসব দোকানে বেশিই বিক্রি হচ্ছে কম দামের ক্যাপ নামের হেলমেট।

বিক্রেতারা বলছেন, এসব হেলমেট মোটেই যাত্রীকে কোন নিরাপত্তা দিতে পারবে না। যেখানে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে পারে এমন একটি হেলমেটের দাম ১৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা বা তারও বেশি। সেখানে একটি ক্যাপ হেলমেট বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে শুরু করে ৬০০ টাকার মধ্যে।

বিক্রেতারা বলছেন, কমদামের এসব হেলমেট বিক্রি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে দামি এবং ভালো মানের হেলমেট বিক্রি কমেছে। এসব হেলমেটে দুর্ঘটনা থেকে যাত্রী, আরোহীকে রক্ষা করতে পারার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে এসব হেলমেট ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানান তারা। দোকানীদের সাথে কথা বলতে বলতেই মোটরসাইকেলে দোকানের সামনে এসেই এক ক্রেতা জানতে চাইলেন সবচেয়ে কম কত টাকা দামের হেলমেট আছে।

সামনে গিয়েই সাংবাদিক পরিচয়ে জানতে চাইলে এক গাল হাসি দিয়েই জানালেন, মামলা থেকে রক্ষা পেতে, পুলিশ থেকে বাঁচতেই হেলমেট দরকার। সে কারণেই কম দামের একটা হলেই হলো। জাস্ট ফরমালিটি রক্ষা করা। নিজের নিরাপত্তা বিষয়টি ভেবে ভালো হেলমেট ব্যবহার করা উচিত কী না এমন প্রশ্নের জবাবে আবারও একগাল হাসি দিয়েই জানালেন, সেটাতো অবশ্যই।

পুরান ঢাকার এক বাইকার অত্যন্ত গর্বের সাথেই বললেন, আমরা পুরান ঢাকার পোলাপানতো আগে হেলমেটই ব্যবহার করতাম না। এখন বাধ্য হয়েই পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হেলমেট ব্যবহার করতে হয়। না হলে তো মামলা খেতে হবে।

চাহিদা বেশি থাকায় বেশিরভাগ দোকানগুলোতে কম দামের হেলমেটগুলোই বেশি রাখা হয়েছে। বিক্রিও হচ্ছে বেশি। তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেল কয়েকটি ভালো হেলমেট বিক্রির দোকানে। এক বিক্রেতা আক্ষেপের সুরেই জানালেন, খারাপ হেলমেট রাখিনা বলেই কোন বেচাকেনা নেই। ভালো হেলমেট বিক্রি অনেক কমেছে। ফলে ব্যবসাটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।

ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল

হেলমেট বিক্রির খোঁজ নিতে নিতেই দেখা গেল  মোটরসাইকেলের সামনে ছোট্র মেয়েকে বসিয়ে হেলমেট কিনতে এসেছেন এক দম্পতি। স্বামী মোটরসাইকেলে বসে আছেন স্ত্রী কম দামের হেলমেট হাতে নিয়ে দরদামে ব্যস্ত। কম দামের হেলমেটতো কোন নিরাপত্তাই দিতে পারবে না তারপরও কম দামের হেলমেট কেন কিনছেন কাছে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হঠাৎ পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছি। প্রস্তুতি না থাকায় কম দামের হেলমেট কিনতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা বিষয়টি এতে উপেক্ষিত হচ্ছে কী না জানতে চাইলে স্বীকার করেই বললেন, কিছুদিন পরেই ভালো হেলমেট কিনে নিবো।

একই ধরনের বক্তব্য মিললো হেলমেট কিনতে আসা আরও অনেক ক্রেতাদের কাছ থেকে। তবে নিম্নমাণের হেলমেট কেনার পিছনে যুক্তিও আছে তাদের। ক্রেতারা বলছেন, এসব হেলমেট বহনে সুবিধা। তা ছাড়া দামি হেলমেট চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভালো মানের হেলমেট যেগুলো বাইকারদের নিরাপত্তা দিতে পারে। সেগুলো সাধারণত ইন্ডিয়া, চায়না থেকে থেকে আমদানি করা হয়। যার এক একটি ১৫০০ থেকে শুরু ৩৫০০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অন্তত দুটো স্তর থাকে। উপরে থাকে ফাইবার অংশ এবং ভিতরে এক ধরণের ফোম জাতীয় কাপড় থাকে। যেটি প্রথম স্তর থেকে আসা আঘাতের মাত্রা শোষণ করে চালক আরোহীর মাথার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যার ফলে চালক বা আরোহীর মাথায় আঘাতের মাত্রা কমে যায়।

অন্যদিকে কমদামের হেলমেট যেগুলো বিক্রেতারা ক্যাপ বা বাংলা হেলমেট বলছে। সেগুলো ২০০-৩০০ থেকে শুরু করে ৬০০-৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। কোন ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারবে এমন পরীক্ষা ছাড়াই স্থানীয় কারখানাগুলোতে তৈরি হচ্ছে এসব হেলমেট।

এই ধরনের হেলমেটগুলোতে নিরাপত্তা দিতে পারবে এমন কোন স্তরই নেই। ফাইবার বা প্লাস্টিক দিয়েই এক স্তরে তৈরি হচ্ছে এসব হেলমেট। অনেক সময় পাতলা কাপড় ব্যবহার করলেও সেটা দুর্ঘটনার কোন মাত্রা কমাতে পারবে না। বিক্রেতারা বলছে, এই হেলমেট কোনভাবেই হাত থেকেই একটু জোরে পড়লেই ভেঙে যাবে সেখানে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করার তো প্রশ্নই আসে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নতুন মোটরযান নিবন্ধন-সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডারের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম চারমাসে শুধুমাত্র রাজধানীতে ৩২ হাজার ৫৬২টি মোটরসাইকেলে নিবন্ধিত হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে সড়কে নেমেছে ৮ হাজার ১৪০টি মোটরসাইকেল দিনের হিসাবে ২৭১টি। যাত্রী পরিবহনে রাইড শেয়ারিং অ্যাপস সুবিধা নিতেই বাইক বিক্রি বাড়ছে বলে জানাচ্ছে বিশেষজ্ঞরা। এই ক্ষেত্রে চালক ভালো হেলমেট ব্যবহার করলেও অধিকাংশ আরোহীর নিম্নমাণের হেলমেট ব্যবহার করছে।

ছবি: আবু সুফিয়ান জুয়েল

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) দেয়া তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যারা মারা যাওয়া ৮৮ শতাংশই কোন হেলমেট থাকে না।

এআরআই গবেষক ও প্রভাষক শাহরিয়ার পারভেজ বিডিমর্নিংকে বলেন, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অধিকাংশ মারা যায় মাথায় আঘাত পেয়ে। এই ক্ষেত্রে হেলমেট আঘাতের মাত্রা কমিয়ে দেয়। হেলমেটের ভিতরে থাকা ফোম দুর্ঘটনায় পাওয়া আঘাতের তীব্রতা চুষে নেয়। ফলে মাথায় আঘাতের পরিমাণ কমে যায়। কমদামের এসব হেলমেট নির্মাণের ক্ষেত্রে ইট বা পাথরের টুকরো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। ফলে এই ধরনের হেলমেট মোটরসাইকেল আরোহীকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না।’

বিদেশে নিজের প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ করে এই গবেষক জানান, ‘হেলমেট  তৈরিতে গতিশক্তিকে স্থিতিশীল শক্তিতে রুপান্তরিত হওয়ার পর তার যে শক্তি হয়। সেই শক্তি একটা হেলমেট তৈরির পর সেটাতে প্রয়োগ করে হেলমেটকে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি এসব হেলমেটে সেটির কোনটাই করা হচ্ছে না।’

এ বিষয়ে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এরআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহার করলে হতাহতের সংখ্যা ৪০ শতাংশ কমে যায়। আর মারাত্মক আহত হওয়া থেকে ৪০/৪৫ শতাংশ কমে যায়। এই ক্ষেত্রে পুলিশকে ফাঁকি দিতে কমদামের হেলমেট ব্যবহার করা আর নিজের জীবনের সাথে ফাঁকি দেওয়া সমান কথা।’

মামলা থেকে রক্ষা পেতে নিম্নমানের এসব হেলমেট ব্যবহারের প্রবণতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা দক্ষিণ ট্রাফিক পুলিশের উর্ধ্ধতন কর্মকর্তা শাহেদ বিডিমর্নিংকে বলেন, ‘হেলমেট ব্যবহার করা, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করে রাস্তা পার হওয়া এসব বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশ কম জনবল নিয়ে শক্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মামলা থেকে বাঁচতে নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহার করলেও এখন ৯০ শতাংশ মানুষের মধ্যে আইন মানার যে প্রবণতা বাড়ছে এটা ভালো দিক। আমাদের ট্রাফিকের লোকবল বাড়লে ভবিষাতে হয়তো তাদেরকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ভালোমানের হেলমেট ব্যবহার করার বিষয়ে উৎসাহ দেয়া সম্ভব হবে।’

Bootstrap Image Preview