‘স্যার আমি অসুস্থ। আজ ২০ দিন ধরে রিমান্ডে। এখনও ২৭ দিন রিমান্ডে থাকতে হবে। আমার রিমান্ডটা একটু কনসিডার করেন।’ দুদকের মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড শুনানি শেষে বিচারককে লক্ষ্য করে এই অনুরোধ জানান রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ।
সোমবার (১০ আগস্ট) দুপুর ১২টায় সাহেদকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হয়। এরপর এক পুলিশকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘স্যার আমার হেলমেট ও হাতকড়া খুলে দেন।’ এরপর তা খুলে দেওয়া হয়। পরে পানি খেতে চায়। এর কিছুক্ষণ পরেই রিমান্ড বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। শুরুতে বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন, তার কোনো আইনজীবী আছে কিনা। তিনি (সাহেদ) বলেন, ‘আমার কোনও আইনজীবী নেই। আমি নিজেই কিছু বলবো।’ সাহেদ বলেন, ‘স্যার আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে ৫০ লাখ টাকার এফডিআর ছিল। আমরা এফডিআর দেখিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছি। তার সব এভেডিয়েন্স রয়েছে। আমি কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি।’
এরপর দুদকের পক্ষে আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘সাহেদ এমআরআই মেশিন কেনার জন্য দুই কোটি টাকার প্রয়োজন বলে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। সেই টাকা দিয়ে মেশিন না কিনে পুরা টাকাই আত্মসাৎ করেন। তাই তার রিমান্ড মঞ্জুর করা হোক।’
শুনানির শেষ পর্যায়ে বিচারককে লক্ষ্য করে রিমান্ড কনসিডারের আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালত সূত্র জানায়, আজ দুপুর ১২টায় বিশেষ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সাহেদকে আদালতে হাজিরের কিছুক্ষণ পরেই শুনানি শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে সাহেদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক রিমান্ড শুনানির জন্য সোমবার (১০ আগস্ট) দিন ধার্য করেছিলেন।
এর আগে গত ২৭ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ বাদী হয়ে সাহেদসহ চার জনের বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার অপর আসামিরা হলেন—পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড (সাবেক দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড)-এর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী/অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী, বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল হক চিশতি এবং রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইব্রাহিম খলিল।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, রিজেন্ট হাসপাতালের জন্য ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখা থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এমআরআই মেশিন কেনার জন্য দুই কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করেন মো. সাহেদ। অথচ ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ও ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং নিরূপণ না করেই ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির সভাপতি মো. মাহবুবুল হক চিশতী ঋণ অনুমোদন করেন।
পরে ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি ২১তম সভায় সাহেদের অনুকূলে দুই কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হয়। যা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ও এমআরআই মেশিন কেনা হয়েছে এমন জাল কাগজপত্র দেখিয়ে ২১ জানুয়ারি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উত্তরা মহিলা শাখার মাধ্যমে দুই কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়।
তবে শর্তানুযায়ী এক কোটি টাকার এফডিআর করতে হয় সাহেদকে। কোনো কিস্তি পরিশাধ না করায় ঋণ হিসাবটি অনিয়মিত হওয়ার কারণে ব্যাংকের কাছে লিয়েন থাকা ওই এফডিআর থেকে এক কোটি টাকা সমন্বয় করা হয়। আর বাকি এক কোটি টাকা আনাদায়ী থেকে যায়। যা এখন সুদসহ দুই কোটি ৭১ লাখ টাকা হয়েছে। সাহেদ ঘুষ বাবদ ৩৫ লাখ টাকা বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স লিমেটেড নামের প্রতিষ্ঠানের হিসাব নম্বরে (হিসাব নম্বর-০১১১১০০০০২৩৬৩) জমা করেন। যে প্রতিষ্ঠানটির এমডি রাশেদুল হক চিশতি।
গত ২২ জুলাই এনআরবি ব্যাংক থেকে হাসপাতালের নামে ঋণ বাবদ দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। এই সময় পরীক্ষা ছাড়াই করোনার সনদ দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর ৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে রিজেন্ট হাসপাতাল ও তার মূল কার্যালয় সিলগালা করে দেয় র্যাব। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে ওই দিনই উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়। এরপর থেকে সাহেদ পলাতক ছিল। গত ১৫ জুলাই ভোরে ভারতে পালানোর সময় সাতক্ষীরা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব।
হাসপাতালে অভিযানের পর থেকে সাহেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাধ্যমে দুদকে অভিযোগ আসতে শুরু করে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি। কমিশনের উপপরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। এ দলের অন্য সদস্যরা হলেন—মো. নেয়ামুল হাসান গাজী ও শেখ মো. গোলাম মাওলা।