ইউনিফর্ম বা উর্দি। নিছক কোন পোশাক নয়। ইউনিফর্ম গায়ে লাগলে সাধারণ মানুষটি অসাধারণ হয়ে উঠেন। আর্মি বা পুলিশের পোশাক পরিহিত একজন সদস্য সাধারণ অবস্থার তুলনায় অধিক সম্মান এবং সমীহ পেয়ে থাকেন সমাজে। সাধারণ মানুষ উর্দির সম্মান দিতে জানে। এই ইউনিফর্মের গৌরবের অংশ হতে দেশের নতুন নতুন ছেলে-মেয়েরা প্রতিরক্ষাবাহিনীসমূহ ও বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করে। একটি ইউনিফর্মের মালিক হতে একেকজনকে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়। মেধা ও পরিশ্রমের সম্মিলনে অনেক প্রতিযোগিতা করে একজনকে ইউনিফর্ম অর্জন করতে হয়। একটি ইউনিফর্ম তাই ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্মানের প্রতীক।
উর্দিবিহীন একটি পেশার লোক হয়ে উর্দি নিয়ে এত কথা কেন বলছি? বলছি, কারণ কখনো কখনো ইউনফর্মধারীদের আমরা ভালোবাসি। যখন দেখি করোনার মত দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের আর্মি, পুলিশ দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন তখন ভালোবাসা মন থেকে আসে। আমার দেশের আর্মি, পুলিশ হয়ত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাহিনী নয়। কিন্তু বাহিনী তো আমার দেশের। আমাদেরই সন্তানেরা, ভাই-বোনেরা, বাবা-চাচারা এসব বাহিনীতে কাজ করেন। জঙ্গির বিরুদ্ধে লড়েন, দেশী-বিদেশী অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়েন। জীবনের বিনিময়ে লড়েন। সন্ত্রাসীদের হাতে পুলিশ মারা যায়নি এদেশে? পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের হাতে আর্মি মারা যায়নি আমার দেশে? বিশ্বের নানা দেশে শান্তির প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমার দেশের সেনা সদস্য প্রাণ হারায়নি? হারিয়েছে; মানবতার পক্ষে লড়তে গিয়ে, শান্তির পক্ষে লড়তে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর সদস্যরা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রাণ দিয়েছে, শহীদের মর্যাদা অর্জন করেছে। যুদ্ধ করেই তো অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশ।
ভারত বা পাকিস্তানের মত ব্রিটিশের দিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা নয় আমাদের। একটা ইউনিফর্ম যদি একটি বাহিনী যদি রাষ্ট্রের সম্মানের প্রতীক হয়ে থাকে, তাহলে কোনো চলচ্চিত্রে সেই বাহিনীকে সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে দেখানো, যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে আততায়ীর হাতে আর্মি, পুলিশ, র্যাবকে মার খেতে দেখানো কি রাষ্ট্রের প্রতি অসম্মান নয়? হ্যা, আমি ‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’ খ্যাত রুশো ব্রাদার্স প্রযোজিত ‘এক্সট্রাকশন’ মুভির কথা বলছি। পরিচালক তাদের দীর্ঘদিনের সহযোগী অ্যাকশন পরিচালক স্যাম হারগ্রেভ। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ‘থর’ খ্যাত ক্রিস হেমসওর্থ।
এই মুভিতে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের আর্মি, পুলিশ, র্যাব সন্ত্রাসীদের সহযোগী! ইয়েস, এমনটাই দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ আর্মি, পুলিশ, র্যাবের গৌরবান্বিত ইউনিফর্মের সম্ভ্রমহানী করা হয়েছে এই মুভিতে। জানি না, একজন আর্মি বা পুলিশ সদস্যের এই মুভি দেখে কেমন লেগেছে বা লাগছে? কিন্তু বাংলাদেশের একজন সার্বক্ষণিক নাগরিক হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানে লেগেছে। আমি মনে করছি আমার মায়ের ইজ্জতের উপর হামলা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নাগরিক আজ ক্ষুব্ধ। সিনেমা শুধু সিনেমা নয়; সিনেমার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। চলচ্চিত্র পারে সমাজগঠনে শক্ত ভূমিকা রাখতে। আবার চলচ্চিত্র বাস্তবতাকে আড়াল করে একটি মিথ্যাকে মানুষের মগজে স্থাপন করে দিতে পারে। এমন সিনেমার জন্যই আজ পুরা আফ্রিকা অঞ্চল আমাদের কাছে ‘অন্ধকার মহাদেশ’।
সিনেমায় নিজেদের বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী বিশ্বের বহু সভ্য দেশের, সভ্য জাতির চরিত্র হনন করেছে, করে চলেছে। এরকমই একটু মুভির নাম এক্সট্রাকশন। পুরো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র হনন করা হয়েছে এই মুভিতে। কানাডা প্রবাসী লেখক, নির্মাতা ও প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াহিদ ইবনে রেজা এই মুভিতে ল্যাঙ্গুয়েজ কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ওয়াহিদের এক লেখা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের অভিনেতা তারিক আনাম খানের নেতৃত্বে যে দলটি হলিউডের অ্যাভেঞ্জার্স: এজ অব আলট্রন ছবিতে কাজ করেছিলেন, তারাই আবার কাজ করছেন এই ছবিতে।
সিনেমার মূল গল্প বাংলাদেশের ঢাকা শহর নিয়ে। এতে দেখানো হয়েছে, ভারতের মুম্বাইয়ের এক ডনের ছেলেকে অপহরণ করে বাংলাদেশের এক ডন। আর তাকে উদ্ধার করতে নিয়োগ করা হয় দুর্ধর্ষ আততায়ী ক্রিস হেমসওর্থকে। ছবির ট্রেলার বেরোয় ৭ এপ্রিল। ছবিটি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় ২৪ এপ্রিল। ‘এক্সট্রাকশন’-এ অভিনয় করেছেন ক্রিস হেমসওয়র্থ। এ ছবিতে তিনি মার্সেনারি টাইলার রেকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। আরও অভিনয় করেছেন ইরানি অভিনেত্রী গোলশিফতা ফারাহানি, ভারতের রণদীপ হুদা ও পঙ্কজ ত্রিপাঠিসহ অনেকে। ভারত ও বাংলাদেশের ক্রাইম লর্ডদের লড়াই নিয়ে এই সিনেমার কাহিনী।
যেখানে ভারতীয় এক মাফিয়ার ছেলেকে অপহরণ করে আনা হয় ঢাকায়। তাকে উদ্ধারের জন্য আসে ক্রিস। ঢাকার প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও মূল দৃশ্যায়ন হয়েছে ভারতের আহমেদাবাদের একাধিক লোকেশনে। সেখানে বাংলাদেশের মতো করেই সেটা তৈরি করা হয়। পরে ঢাকায় সামান্য কিছু শুট করা হয়। সিনেমার নিজেদেরকে সুপ্রিম দেখিয়ে অন্য রাষ্ট্রের চরিত্র হনন করা হলিউড, বলিউডের একটি নিয়মিত বিষয়।
হলিউডের অনেক সিনেমায় দেখানো হয়, রাশিয়া, চীন, ইরানের সন্ত্রাসীরা কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীকে জিম্মি করে রেখেছে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সোলজার কমান্ডো হয়ে সব উদ্ধার করছেন। ভারতের নানা সিনেমায় সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানের থাকে। আর সন্ত্রাসীরা যদি অভ্যন্তরীণও হয় তবু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার একটা ধর্মপরিচয় থাকে এবং সে পরিচয় হয় মুসলিম। চোখে সুরমা থাকে, কপালে থাকে সিজদার দাগ! মানুষ খুন করার আগে এদের মুখ দিয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বের করা হয়। এক্সট্রাকশন মুভিটিও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের চরিত্র হননের মাধ্যমে প্রতিবেশি ভারতে নেটফ্লিক্সের বাজার তালাশ করা হয়েছে। এই মুভিটি মূলত ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া দুর্বৃত্তদের একটি যৌথ বিপদজনক প্রযোজনা।
প্রতিবাদ হবে না? প্রতিবাদ করতেই হবে। বাংলাদেশের আর্মি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে তা নয়, বিশ্বের নানা দেশে শান্তি রক্ষায় রয়েছে এই সুদক্ষ বাহিনীর ঐতিহাসিক অবদান। বাংলাদেশ পুলিশ ১৬ কোটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার কাজে ব্যস্ত। করোনা মোকাবেলায় দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে আর্মি, পুলিশ, র্যাবের সদস্যরা। জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় এই বাহিনীগুলোর সাফল্য আকাশচুম্বী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগ থেকে পুলিশ বাহিনী প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিল।
বাংলাদেশ, আর্মি, নেভি- এই তিনবাহিনীর জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ডামাডোলে। তাই আমাদের আর্মি, পুলিশের আত্মসম্মানবোধ বেশিই হওয়ার কথা। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ আর্মি, বাংলাদেশ পুলিশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলে কূটনৈতিক উপায়ে, গণমাধ্যম ব্যবহার করে, পারলে আইনি কোন ব্যবস্থা নিয়ে এই চলচ্চিত্র-সন্ত্রাসের জবাব দেবে।
ফেসবুকে এই মুভি সম্পর্কে আমার একটি ফেসবুক পোস্ট দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা আমার ইনবক্সে একটি পর্যবেক্ষণ পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আপনি যে সিনেমা নিয়ে লিখেছেন, সেটি হলো তথ্য অস্ত্রের প্রয়োগ। Subversive Propaganda-র একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আধুনিক নিরাপত্তা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান আছে এমন যে কেউ এই সিনেমা দেখে শিউরে উঠবে। জাতিকে বিভ্রান্ত করা, জাতির প্রতিরক্ষার সাথে জড়িতদেরকে সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সংশয় সৃষ্টির প্রচেষ্টা এই চলচ্চিত্র। ওরা জানে যে জনগণ আর প্রতিরক্ষা বাহিনী যদি একসাথে সক্রিয় থাকে- তাহলে ষড়যন্ত্র কার্যকর হয় না। কোন স্বাধীন দেশে আগ্রাসন চালিয়ে জেতা যায় না। তাই প্রতিরক্ষার সামাজিক ভিত্তি, রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোর ঐক্যে ফাটল ধরানোর অপচেষ্টা চালায়। এই সিনেমাই শুধু নয়, বহু মিডিয়া তলে তলে জাতির শেকড় কাটার কাজে ব্যস্ত’।
ইন্ডিয়া-আমেরিকার যৌথ মগজ-প্রসুত এই মুভিতে বাংলাদেশের আর্মি, পুলিশকে সন্ত্রাসের সহযোগী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে আইএস আছে মর্মে বিশ্বের নানা মিডিয়া তৎপরতা চালিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার জনগণকে সাথে নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আইএস-সংক্রান্ত ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছে। এখন এই সিনেমার প্রতিবাদ না করলে অচিরেই হয়ত বাংলাদেশকে আইএসের কেন্দ্র হিসেবে দেখানো হবে। এই একই চলচ্চিত্রে যদি ভারতের আর্মি ও পুলিশের অফিসিয়াল ইউনিফর্ম ব্যবহার করে তাদেরকে সন্ত্রাসের সহযোগী হিসেবে দেখানো হত তাহলে ভারত চুপ করে বসে থাকত না।
যদিও ভারতীয় অনেক চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে অত্যন্ত আপত্তিজনকভাবে তুলে ধরা হয়। ভারতের চলচ্চিত্রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেয়ার মত বহু উদাহরণ আছে। বাংলাদেশের সরকার কখনো প্রতিবাদ করে, কখনো করে না। ‘গুন্ডে’ সিনেমায় বঙ্গবন্ধুকে অপমানজনকভাবে তুলে ধরা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানালে এর নির্মাতা, প্রযোজক প্রতিষ্ঠান ক্ষমা চেয়েছিল এবং আপত্তিজনক অংশ কেটে বাদ দিয়েছিল।
আমরা বিশ্বাস করি, নেটফ্লিক্সকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় শক্ত প্রতিবাদ জানাবে। পাশাপাশি দেশের শিক্ষিত, সচেতন মহল দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে, ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে, টেলিভিশন-রেডিওতে প্রোগ্রাম করে ‘এক্সট্রাকশন’ মুভিতে বাংলাদেশের চরিত্র হননের প্রতিবাদ জানিয়ে শক্ত বার্তা দেয়া অব্যাহত রাখবে। আমরা আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমাদের মেরুদণ্ড থাকলে আমরা অবশ্যই প্রতিবাদ করব।
সহকারি অধ্যাপক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, দীর্ঘদিন বার্তা সংস্থা ইউএনবি’র রিপোর্টার ছিলেন।
চ্যানাল আই থেকে সংগৃহীত