প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের চূড়ান্ত রেজাল্ট প্রকাশ হবার পর থেকেই এটা নিয়ে এখন পর্যন্ত চলছে আলোচনা সমালোচনা। চলতি মাসের ১৬ তারিখ উত্তীর্ণদের যোগদান দেবার কথা থাকলে হাইকোর্টের রিটের কারণে স্থগিত রয়েছে তাদের যোগদান।
তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা নিয়ে প্রার্থীরা শঙ্কিত। এরকম এক প্রার্থীর নাম সৈয়দ ফেরদৌস হাসান। তিনি ফেসবুকে আক্ষেপ ঝেড়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
পাঠকদের জন্য লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
১৪ সেপ্টেম্বর বাড়ি থেকে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য চাকুরীর পরীক্ষা। যথারীতি ১৫ তারিখ সকালে ঢাকা পৌঁছালাম। সন্ধ্যায় হঠাৎ একটা খুদে বার্তা পেলাম। খুদে বার্তাটিতে ছিল আমি ডিপিই’র রিটেনে উত্তীর্ণ হয়েছি। তেমন একটা আশ্চর্য হইনি কারণ এর আগেও ৩০টা এরকম রিটেন কোয়ালিফাই হয়ে ভাইবা সিটে বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি সাধারণত ফেসবুকে তেমন কিছু লিখি না, কারণ আমার লিখার হাত তেমন ভাল না। আজ কেন যেন ভিষন্নতা পেয়ে বসেছে। তাই আপনাদের কে একটু কষ্ট দিচ্ছি আরকি! যাইহোক তারপর যথারীতি বাড়ি এলাম। ভাইবার ডেট হলে আমার পরীক্ষা ২৩ অক্টোবর। এর মধ্যে ১১ অক্টোবর আমার একটা পরীক্ষা ছিলো ডিসি অফিসে।
এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখতে চাই, তা হল আমার বাইক দুর্ঘটনার কথাটি। ডান পায়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়। হাটতে খুব কষ্ট হত। হাটা চলা ফেরা ডাক্তারের বারণ ছিল। বারণ থাকলেই বা কি আমার তো একটা জবের প্রয়োজন। ১১ অক্টোবর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ডিসি অফিসের পরীক্ষার জন্য রওনা হলাম। পরীক্ষা আমার মনমত হলো না। শুনলাম ঐ দিনেই রাতেই রেজাল্ট ও ১২ তারিখ ভাইবা। রাত ১০ টার দিকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাবলাম দেখি ডিসি স্যারের ওয়েব সাইটে কোন রেজাল্ট দিল কি না। না রেজাল্ট পেলাম না। ভাবলাম ডিসি স্যারের ফেসবুক পেজে একবার দেখি কী অবস্থা। ওখানে দেখলাম রেজাল্ট হইছে।
প্রথমে হিসাব করে দেখলাম কয়জনকে টিকালো। দেখলাম মেবি ১০৪ জন এরকম হবে আরকি। তারপর আমার রেজাল্টটা খোঁজার চেষ্টা করলাম। দেখি ওর মধ্যে আমার রোল নম্বরটাও আছে। দেখে অবাক লাগল। যা হোক ১২ তারিখ সকাল বেলা একপায়ে ব্যান্ডেজ ও অন্যপায়ে একটি সু পরে রওনা হলাম ডিসি অফিসে ভাইবা দেওয়ার জন্য। আমার ভাইবার ডাক পেলাম বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে।
সালাম দিলাম। ডিসি স্যার বসতে বললেন। সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে সাবধানে বসলাম। আমার সাবজেক্ট ছিল হিসাব বিজ্ঞান। প্রথমে সাবজেক্ট থেকে বেশকিছু প্রশ্ন করল ভালই উত্তর করলাম। পাশ থেকে অন্য একজন আমার নাম নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। কারণ আমার নামটা সাধারণত মেয়েদের হয়ে থাকে। জান্নাতুল ফেরদৌস এরকম নাম সাধারণত অল্প সংখ্যক ছেলেরই হয়ে থাকে। আমাকে ৮টা জান্নাতের নাম বলতে বলল ও ৭টা যে দোজখ আছে সেই নাম গুলো জানি কিনা তাও জানতে চাইল। ভাইবা বোর্ড আমার জন্য অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ বলে মনে হতে থাকল। ভাইবার একদম শেষ মুহূর্তে আমি সাহস করে বলে ফেললাম স্যার আমি আপনাদেরকে কিছু বলতে চাই। তারা কোন ভাবেই আমার কথা শুনবে না। আমি অনেক জোরাজুরি করে সেদিন কিছু কথা বলেছিলাম।
সেদিন বলেছিলাম আমার অসহায়ত্বর কথা। আমি বলেছিলাম স্যার আমার বাবা বিগত হয়েছেন প্রায় ৭ বছর হয়েছে। আমার একটা সংসার আছে যা অনেক কষ্টে চালনা করি আমি। এও বলেছিলা স্যার আজ আমি ৩১তম ভাইবা সিটে বসে আছি। স্যার জবটা আমার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ওপাশ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যে এগুলো কথা ভাইবা বোর্ডে বলতে নেই। আমি নিজেও তা জানি। কিন্তু আমিতো নিরুপায়, এভাবে আর কত দিন চলবে। বেকারত্বের যে কী অভিশাপ তা আমি জানি।একজন একটু আসা দিল ঠিক আছে যাও দেখি কী করা যায়। আশায় বুক বেধে থাকলাম।
যেদিন রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিলো সেদিন আর রেজাল্ট হল না। রেজাল্ট হল ১৩ অক্টোবর রাত ১১টা ৩০ মিনিটে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে রেজাল্ট খুঁজতে লাগলাম। কোথাও খুঁজে পেলাম না আমার স্বপ্নের রোল নম্বরটা। বাসায় রাত্রে আর কিছু জানালাম না। সকালে বলার পর অবশ্য আমার পরিবারের কেউ আর সেদিন খানাপিনা করেনি। এক কথায় বলতে পারেন অঘোষিত সিয়াম সাধনা। আমি অবশ্য পরের দিন সকালে খেয়েছি। যাইহোক আল্লাহ্ যা করেন হয়তো ভালোর জন্যই করেন। আল্লাহ্ ভরসা।
তার পর আমার চট্টগ্রামে হঠাৎ একটা কাজ পরলো। আমি ২৪ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলাম। সন্ধ্যায় আমার এক কলিগের বাসায় উঠলাম অবশ্য উনিও আমার সাথে চট্টগ্রাম যাবে এ জন্য উঠা। ফ্রেশ হলাম। খুব খিদে পেয়েছিল তাই ভাইকে বলে রাতের খাবারটা খেয়ে নিলাম। ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ দেখলাম আজ প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকের রেজাল্ট হতে পারে। ফেসবুকের অনেক কিছুই আমি বিশ্বাস করি না। হঠাৎ আমার মোবাইলে একটা মেসেজ এলো বুঝতে পারলাম তখন আনুমানিক রাত ১১টা হবে। দেখলাম ডিপিইর মেসেজ। মেসেজ এ যা আছে তা বাংলা করলে এরকম মানে দাঁড়ায় যে, আমাকে ওনারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করেছেন। সেদিন কেমন অনুভূতি হয়েছিল বলতে পারব না তবে এতোটুকু বলতে পারব আমার মায়ের টেনশনটা যদি এখন একটু কমে। মাকে প্রথমে জানালাম। মা আমার খুব খুশি। ফেসবুকে শুধু আলহামদুল্লিল্লাহ লিখে একটা পোস্ট করলাম। অবশ্য সাথে মেসেজের একটা স্ক্রিনশটও জুড়ে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই ফোনে কল দেওয়া শুরু করল।
আমাকে উইস করতে লাগল। আমার এলাকার একজন কেও আমি খুঁজে পাইনি যে আমার রেজাল্টটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মনে কষ্ট পেয়েছে সে যদিও আমার চরম শত্রুও হতো। আমার এলাকায় আমি এও শুনেছি আমার রেজাল্ট আছে কিনা অনেকে শুধু এতটুকু জানতে চেয়েছে বুঝেন কতোটা বেকারত্ব হলে এমনটা হয়। আমার এলাকায় আমার সাথে আরো ৭ জনকে কোয়ালিফাই করা হয়। তারা আমার চেয়ে অনেকগুণ মেধাবী ও অনেক নিডি পরিবারের ছেলে মেয়ে। তাদের পরিবারের প্রিয়জনরা আসায় বুক বেধে আছে আমার পরিবারের মত যেমন আমি আমার মায়ের পায়ের ব্যথার চিকিৎসার জন্য একজন বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
আমার রেজাল্টটা হওয়ার পরেই আমার মা আমাকে ডেকে বলল শোন আমাকে এবার একটা বড় ডাক্তার দেখাবি আমার পায়ের ব্যথাটা কেমন যেন দিনদিন বেড়েই চলছে। মাকে বললাম চিন্তা করোনা এখন তো আর কোন সমস্যা নেই, এখনতো আর বেকার নই চল দুই একদিনের মধ্যেই ডাক্তার দেখাইয়া আসি। মা বলে টাকা পাবি কউ। আমি বললাম কেন এখন কার থেকে ধার করব বেতন থেকে দিয়ে দিব। মা বলল নারে এখন ডাক্তার দেখাতে হবে না তুই প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসা করাবি।
যাইহোক ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কাজ শেষ করে ২৬ ডিসেম্বর বাড়ি পৌঁছালাম। বিকালে বাজারে আসলাম সবাই অনেক খুশি বন্ধ-বান্ধব, ছোট ভাই, বড় ভাই ও আরো অনেকে ধরল খাওয়া দিতে হবে। এমন সময় রেজাল্টটা দিল আমার কাছে তেমন কোন টাকা পয়সাও নেই। যাহোক চাকরি যেহেতু পাইছি তো বেতনও তো পাব। এখন ঋণ করতে তো সমস্যা নেই। খাওয়াতে তো হবেই। আমার এক আত্মীয়র কাছে ১৫ হাজার টাকা ধার করলাম যে বেতন পেয়ে আস্ত আস্ত দিব অবশ্য আমি কখন টাকা ধার করি না সে ভাল করেই জানে।
একটা ডেট করা হল সবাই মিলে পিকনিক খাওয়া হবে। যেমন কথা তেমন কাজ। সবাই আনন্দ করলাম। আমার আত্মীয় স্বজনের বাসায় মিষ্টি নিয়ে গেলাম। এখানে গেলাম ওখানে গেলাম। জয়েনিং এর জন্য কাগজ পত্র রেডি করতে লাগলাম, স্কুল চয়েজের জন্য ডিপিও অফিস দৌড়াতে লাগলাম। যেখানেই যাই শুধু টাকা আর টাকা লাগতে লাগলাে। এদিকে আমার ঋণের বোঝা বড় হতেই থাকল। যখন ঘোষিত বেকার ছিলাম তখন আমার একটাকাও ঋণ ছিল না আজ অঘোষিত বেকার হয়ে অলরেডি ৩৪ হাজার নতুন ঋণের বোঝা আমার মাথার উপর।
আর এদিকে আমাদের দেশের ভাইবা ফেল করা আসল মেধাবী দাবিকারী ৩৭ হাজার প্রার্থী আদালতে রিট করে আমার মায়ের পায়ের ব্যথার চিকিৎসাটুকুও এতদিন পরে করবার সুযোগ আমাকে দিলোনা। আরো কিছু লেখার ছিল। আমার লেখায় যদি কোন ভুল হয়ে থাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আপনাকে ধন্যবাদ ভাইবা ফেল করা আসল মেধাবী ৩৭ হাজার প্রার্থী দায়ের করা রিটকে আমলে নেওয়ার জন্য।