Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

পুত্রসন্তান না থাকা কি অভিশাপ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০, ০৬:৪৯ PM
আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০, ০৬:৪৯ PM

bdmorning Image Preview


আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষের পুত্রসন্তানই কাম্য। কারণ তারা মনে করে, ছেলেরা বংশের ধারক, তারা আয় করে, বেশি শক্তিশালী। ছেলে না থাকলে সেই বংশের প্রদীপই নেই। অনেকে কারো পুত্রসন্তান না থাকলে তাকে অলক্ষ্মী মনে করে।

এ অবস্থায় যদি পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভে থাকা সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় জানা যায় এবং তা মা-বাবার কাঙ্ক্ষিত না হলে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে। অথচ গর্ভবতী মা যদি হতাশায় ভোগেন, তাহলে বাচ্চার মস্তিষ্কের গঠন বা বিকাশ ঠিকভাবে হয় না। তাই বিশ্বের অনেক দেশে গর্ভে থাকা সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশেও শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে তার লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন একজন আইনজীবী। গত ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় গর্ভবতী নারী ও অনাগত সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান এ রিট দায়ের করেন।

বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে এখনো মানুষ জাহেলি যুগের বর্বর কুসংস্কারপ্রেমী মানুষগুলোর মতো চিন্তা করে। কারো পুত্রসন্তান না থাকলে তাকে অপয়া ভাবা জাহেলি যুগে প্রচলিত ছিল। পবিত্র কোরআনে এই কুসংস্কারের সমলোচনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে জাতি থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখো, তারা যা ফায়সালা করে, তা কতই না মন্দ!’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)

শুধু তা-ই নয়, সে যুগে কারো পুত্রসন্তান বা সন্তান না থাকলে অথবা হয়ে মারা গেলে তাকে ‘আবতার’ বলে তিরস্কার করত। কারণ তার অবর্তমানে তার নাম নেওয়ার মতো কেউ থাকবে না এবং মারা যাওয়ার পর তার নাম-নিশানা মুছে যাবে।

আরবের লোকেরা ‘আবতার’ বলত ওই ব্যক্তিকে, যার শিকড় কাটা গেছে। সে কোনো প্রতিষ্ঠা ও শক্তিমত্তা লাভ করতে পারে না। অথবা তার পরিণাম ভালো নয়। যে ব্যক্তির কোনো উপকার ও কল্যাণের আশা নেই এবং যার সাফল্যের সব আশা নির্মূল হয়ে গেছে তাকেও ‘আবতার’ বলা হতো। সুতরাং কারো পুত্রসন্তান বা সন্তানাদি না থাকলে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। সমাজের যেসব লোক এগুলো নিয়ে বাজে মন্তব্য করে, তাদের মন্তব্য আমলে নেওয়ার মতো নয়।

মক্কার কপাল পোড়া কাফিররা আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-কেও ‘আবতার’ বলেছে। তার জবাবে মহান আল্লাহ এই সুরা নাজিল করেছেন। এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে যারা তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.)-কে ‘আবতার’ বলেছে তারা নিজেরাই ‘আবতার’। এবং সত্যি সত্যি সময়ের পরিবর্তনে তার সব অহংকার, দাম্ভিকতা মহান আল্লাহ দুনিয়া থেকে মুছে দিয়েছেন।

আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ তাঁর ওপর অচৈতন্য ভাব চেপে বসল। অতঃপর তিনি মুচকি হেসে মাথা তুললেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার হাসির কারণ কী? তিনি বললেন, এইমাত্র আমার ওপর একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি পাঠ করলেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’ নিশ্চয়ই আমি তোমাকে ‘কাওসার’ দান করেছি। অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় করো এবং কোরবানি দাও। তোমার কুৎসা রটনাকারীরাই মূলত (আবতার) শিকড় কাটা, নির্মূল। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা কি জানো ‘কাওসার’ কী? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই বেশি ভালো জানেন। তিনি বললেন, এটা একটা ঝরনা। আমার মহান প্রতিপালক আমাকে তা দেওয়ার জন্য ওয়াদা করেছেন। এর মধ্যে অশেষ কল্যাণ রয়েছে, আমার উম্মতের লোকেরা কিয়ামতের দিন এ হাউসের পানি পান করতে আসবে। এ হাউসে রয়েছে তারকার মতো অসংখ্য পানপাত্র (গ্লাস)। এক ব্যক্তিকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আমি তখন বলব, প্রভু! সে আমার উম্মতেরই লোক। আমাকে তখন বলা হবে, তুমি জানো না, তোমার মৃত্যুর পর এরা কি অভিনব কাজ (বিদআত) করেছে। (মুসলিম, হাদিস : ৭৮০)

উল্লিখিত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, মানুষের অহেতুক ভর্ত্সনা বান্দার কোনো ক্ষতিই করতে পারে না। বরং কখনো কখনো এই তিরস্কার বান্দাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আরো বড় পুরস্কারপ্রাপ্তির পথ সুগম করে দেয়। মক্কার কাফিররাও আমাদের প্রাণের নবী (সা.)-কে অপমান করতে চেয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ তাদেরই অপয়া ঘোষণা দিয়ে দিলেন। আর তাঁর হাবিবের সম্মানে সুরা অবতীর্ণ করার মাধ্যমে তাঁকে জান্নাতের একটি বিশেষ ‘ঝরনা’ উপহার দেওয়ার সুসংবাদ দিলেন।

তাই আমাদেরও মানুষের কথায় বিচলিত না হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করা উচিত। আল্লাহ আমাদের জন্য যা কল্যাণকর মনে করবেন, তা-ই দেবেন। আল্লাহর কোনো নিয়ামতকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তা ছাড়া দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিও আল্লাহ আমাদের এই সাময়িক জীবনকে সাজানোর জন্য দিয়েছেন। এগুলো নিয়ে যেমন গর্ব করার কিছু নেই, তেমনি এগুলোকে কেন্দ্র করে কাউকে কটূক্তি করারও অবকাশ নেই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের একটি সাময়িক সৌন্দর্য-শোভামাত্র। আসলে তো স্থায়িত্ব লাভকারী সৎ কাজগুলোই তোমার রবের কাছে ফলাফলের দিক দিয়ে উত্তম এবং এগুলোই উত্তম আশা-আকাঙ্ক্ষা সফল হওয়ার মাধ্যম।’ (সুরা : কাহাফ, আয়াত : ৪৬)

উপরোক্ত আয়াতে দুটি জিনিস লক্ষণীয়। প্রথমত মহান আল্লাহ সন্তান-সন্ততিকে জীবনের সৌন্দর্য ও শোভা বলেছেন, ছেলে কিংবা মেয়ে উল্লেখ করেননি। ফলে  যেকোনো একটিকেই শুধু আল্লাহর নিয়ামত ভেবে অন্যটিকে অবজ্ঞা করা অনুচিত। দ্বিতীয়ত আমাদের স্থায়ী সম্পদ বলা হয়েছে আমাদের সৎকর্মগুলোকে, যেগুলোর প্রতিদান মহান আল্লাহ আমাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। সুতরাং সন্তান-সন্ততি নিয়ে কাউকে ছোট না করে নিজের আমলের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

Bootstrap Image Preview