Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

আমার সন্তান থাকুক দুধেভাতে

ফারজানা ইসলাম লিনু
প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারী ২০২০, ০৯:০৩ PM
আপডেট: ২৫ জানুয়ারী ২০২০, ০৯:০৩ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


অনেকগুলো কুখ্যাতির পাশাপাশি হৃদয়হীনা মা হিসেবে আমার কুখ্যাতি মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত। এই কুখ্যাতি নিয়ে আমি তেমন বিচলিত নই। কারণ আমি নিজেও এক হৃদয়হীনা মায়ের কন্যা। চুন থেকে পান খসলে কঠিন হৃদয় জননীর অব্যাহত হুমকি ধামকিতে আমাদের শতবর্ষী কাঠের দোতলা বাড়িটাও থরথর করে কাঁপতো। তিন পুত্রের পর একমাত্র কন্যা হিসেবে কিছু বছর আমার একছত্র আধিপত্য বহাল ছিলো পরিবারে। পিতার কন্যা স্নেহে পক্ষপাতদুষ্টতা স্পষ্ট প্রতীয়মান হলেও অহেতুক প্রশ্রয় ছিলো না বিন্দুমাত্র। পরিক্ষার বিরূপ ফলাফল দর্শনে অসন্তুষ্টি প্রকাশে স্নেহময় পিতার বিন্দুমাত্র কার্পন্য ছিলো না।

"কিছু না বলাটাও যে একটা কঠিন শাস্তি"। আব্বার বাংলা পাঁচের মতো চেহারা ও কুচকানো ললাট দেখে বিরক্তির মাত্রা আঁচ করা যায় সহজে। পরের বার ভালো করার অকপট মুচলেকায় পিতৃ আদালতের বিচার সাময়িক মুলতুবি হয়।

কিন্তু মায়ের আদালতের বিচারে দীর্ঘাসুত্রিতা শেষ হবার নয়।

ফলাফল খারাপের রেশ সবকিছুতে চলে। কোন অনিয়ম করলে মায়ের কাছে রেহাই নেই। কমন হুমকি ও সিলেটি ভাষায় আরো কিছু অতি সাধারণ তিরষ্কারের গল্প বহুবার লিখেছি। হাতকড়া একেবারে নাক বরাবর। বাল্যবিবাহ দিয়ে বনবাসে নয় দুর্গম হাকালুকিতে জলবাসে পাঠানোর মৌখিক সিদ্ধান্তে অনঢ় মা।

ছাগলের চার নাম্বার ছানা অতি সুবোধ বালিকা আমি।সবকিছু ঠিকঠাক মতো করার পরও সকাল সন্ধ্যা মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি বন্ধ নেই। মূল্যবান নসিহতের পাশাপাশি দুনিয়ার সব অনিয়ম ও অপকর্মের বিরুদ্ধে নিজের কঠোর অবস্থান বিষয়ে মায়ের নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা শুনতে হয় তিন প্রহর। প্রতিবার বক্তব্য দীর্ঘায়িত না করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন মা জননী। কিন্তু বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত হয়না, উপরুন্ত আকার ও ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে দিনে দিনে। রাগ যে আমার উঠেনা তা কিন্তু নয়। মায়ের সামরিক শাসনজারিতে বাক-স্বাধীনতার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা। মুখেমুখে কথা বলার কোন অবকাশ নেই।

রাগ চেপে মুখ ভার করে বিনাবাক্য ব্যয়ে শ্রবণ করি।

শাস্তি কার্যকরে মোক্ষম হাতিয়ার কাঁটা গোলাপের বেত হাতের নাগালে, চাইলেই ফেলে দিতে পারি। কিন্তু সে সাহস নেই।

তাই বলে শৈশব কৈশোরের চঞ্চলতা আমাদের থেমে ছিলো না। নিয়মের ভেতর সবকিছুর অনুমতি ছিলো। খুব বেশি অনিয়ম না করলে মায়েরও ঠেকা পড়তো না রাগ দেখানোর।

 

ভর দুপুরে সময় জ্ঞান ভুলে কুত কুত খেলায় নিমগ্ন। মায়ের ডাক কর্ণ গোচরে যায়না। চুলের মুঠির টানে সম্বিৎ ফিরে আসে। খেলার মাঝপথে মায়ের এমন অতর্কিত আক্রমণে কুত কুত বা ফুলগুট্টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আশাহত খেলার সাথীরা মায়ের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে আমাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। সাথীদের এই নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী কয়েকদিন বহাল থাকে। সাথে যুক্ত হয় আঁড়ি নামক শাস্তি।

মেনে নিতে কষ্ট হয়। জোর করে আঁড়ি ভাঙতে গেলে বেহায়া গো বেহায়া বলে ছন্দের কবিতা শুনায়। গা জ্বলে যায়, কান্না আসে। মনে মনে ঠিক করে রাখি আমার সন্তানেরা ইচ্ছামতো কুত কুত ফুলগুট্টি খেলবে, আমি কিচ্ছু বলবো না।

কুতকুত, ফুলগুট্টির যুগ না থাকলেও সন্তানদের ত্যক্ত করা থেমে নেই। মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সব কালো আইন নিয়ে আমিও তৈরি। সন্তানদের উপর এইসব আইন প্রয়োগে মায়ের মতো আমি নির্ভীক বা স্বাধীন নই। কারণ শিশু মনোবিজ্ঞানীরা কথায় কথায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। অজানা ভয় তাড়া করে আমাকে। অতি শাসনে সন্তান যদি আমাকে ভুল বুঝে, রাগ করে গৃহত্যাগ করে, তখন কি হবে?

আমার ভয় অমূলক নয় তা পর পর দুটো ঘটনায় প্রমাণ হয়। এগারো বছরের একটা মেয়ে ও ক্লাস টেনে পড়ুয়া এক কিশোর মা বাবার উপর রাগ করে গৃহত্যাগ করে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করে দিশেহারা পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।

পুলিশের আন্তরিক চেষ্টা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে কন্যা শিশুটি অতি অল্প সময়ের ভেতর অক্ষত উদ্ধার হয়। আড়াই মাসের মাথায় কিশোর ছেলেটাও উদ্ধার হয়েছে। ছেলের চিন্তায় শয্যাশায়ী মা বিছানা ছেড়ে ছেলেকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। বুকের ধন অক্ষত ফিরে এসেছে, এর বেশি আর কি হতে পারে? সন্তানের জন্য অন্তর্দহনের পাশাপাশি অপরাধীর কাঠগড়ায় ছিলেন বাবা মা। সান্ত্বনা দিতে আসা হিতৈষীরা একটু আড়ালে গিয়েই বলেন, মা বাবার এতো কঠোর হওয়া উচিত হয়নি।

সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন পিতামাতা কখনো হয়তো একটু বেশিই প্রত্যাশা করে ফেলেন। তাই বলে সন্তান পিতামাতাকে পরিত্যাগ করবে, এ কেমন কথা?

এই হাইব্রিড প্রজন্মের স্পর্শকাতরতা নিয়ে আমি শংকিত। কথায় কথায় অভিমান ও প্রেস্টিজ ইস্যুতে আমরা তটস্থ।বলা হয় বাবা মায়ের ব্যস্ততা, সন্তানকে সময় না দেওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। সেকেলে এক মায়ের প্রতিচ্ছবি হিসেবে আমি এইসব যুক্তির সাথে একমত নই। আগেকার দিনের যৌথ পরিবারের গৃহিণী মায়েরা আরো বেশি ব্যস্ত ছিলেন। সংসারের বোঝা টানতে টানতে নিজের সন্তানের দিকে তাকানোর পর্যন্ত সময় ছিলো না। সেখানে সন্তানের মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার ফুসরত কোথায়?

অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই সব মায়েদের সন্তানেরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যথেষ্ট মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রতিষ্ঠার ধরন ব্যক্তিভেদে হয়তো ভিন্ন হতে পারে।

আজকের দিনে বাবা মায়েরা দিন দুনিয়া ভুলে সন্তানের সেবা ও হিত চিন্তায় মগ্ন। অতিরিক্ত প্যাম্পারিং ও পাত্তা দেওয়ার কারণে সন্তানেরা ধরাকে রীতিমতো মেরিল ভেসেলিনের মিনি কৌটা জ্ঞান করছে। বাবা মায়ের ভালোবাসাকে দুর্বলতা ভেবে শিশুরা সুযোগ নিচ্ছে।

তবে কিছু জিনিসের সাথে একমত না হওয়ার কোন অকাট্য প্রমাণ আমার কাছে নেই। যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন, গল্পের বই বিমুখতা ও অতিমাত্রায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস প্রীতিতে বেশিরভাগ শিশু গোয়ার্তুমি ও একগুয়েমি স্বভাবে আক্রান্ত। সাথে সাথে তাদের সামাজিক বিকাশও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আমি কৃতি উত্তম নই, একেবারে অকৃতি অধম এক মা। আমার প্রাচীন চিন্তাধারায় অনেক ভুল থাকতে পারে। ভুলে ঠাসা যুক্তির সাথে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু দুনিয়ার সবকিছুর উর্ধ্বে আমার সন্তান ও সন্তানের ভবিষ্যৎ। সেই সন্তানের ভালোর জন্য আমি কঠোর কোমল যা ইচ্ছা তা হতে পারি। সন্তানের প্রতি স্বেচ্ছাচারিতা আমার অপরাধ নয়।সন্তানের কাছে অতিমাত্রায় প্রত্যাশা করা অবশ্য গুরুতর অপরাধ।

Bootstrap Image Preview