ঘর বাঁধা হলো না মেডিকেল শিক্ষার্থী তনিমা ইয়াসমিন পিয়াসার। সুখের নীড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর পিয়াসা স্বামীর ঘরে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। একই পরিণতি বরণ করতে হলো তার বোন ও খালাত ভাইয়ের স্ত্রীকে। প্রাইভেটকারের ড্রাইভিং সিটে মদ্যপ অবস্থায় পিয়াসার স্বামী ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জ্যোতি এই দুর্ঘটনা ঘটান। আর তাতে প্রাণ হারান তিনজন।
নিহতরা হলেন, যশোর শহরের ঢাকা রোড বিসিএমসি কলেজ এলাকার ইয়াসিন আলীর মেয়ে তানজিলা ইয়াসমিন (২৮), তনিমা ইয়াসমিন পিয়াসা (২৫) ও পিয়াসার খালাত ভাই আরএন রোড এলাকার মঞ্জুর হোসেনের স্ত্রী আফরোজা তাবাসসুম তিথী (২৬)।
আহতরা হলেন, নিহত তিথীর শিশু সন্তান মাশিয়াব (৪), নিহত পিয়াশার স্বামী প্রাইভেটকার চালক শফিকুল ইসলাম জ্যোতি ও নিকটাত্মীয় কালু (৩০)। গুরুতর আহত মাশিয়াব ও কালুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
নিহত তিথির স্বামী মঞ্জুর হোসেন বলেন, শুক্রবার রাতে শফিকুল ইসলাম জ্যোতি প্রাইভেটকার নিয়ে আমাদের বাসায় যান। শহরে ঘুরতে বের হওয়ার কথা বলে গাড়িতে আমার স্ত্রী (জ্যোতি) ও সন্তানকে (মানিজুর) গাড়িতে তুলে নেন। ওই গাড়িতে জ্যোতির খালাতো দুই বোনও ছিল। তারা শহরের পালবাড়ি, আরবপুর এলাকায় আলোকসজ্জা দেখতে ও বিয়ে দাওতায় দিতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
পিয়াসার মামা শাহিনুর রহমান ঠান্ডু সাংবাদিকদের জানান, শহরের লোনঅফিসপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জ্যোতির সঙ্গে আদদ্বীন সখিনা মেডিক্যালের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তনিমা ইয়াসমিন পিয়াসার দেড় বছর আগে বিয়ে হয়। আগামী ২৩ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পিয়াসাকে তাদের তুলে নেওয়ার কথা। সে জন্য জ্যোতির বাড়িতে আলোকসজ্জা করা হয়। পিয়াসা রাতে ফোন করে জ্যোতিকে জানান, তারা আলোকসজ্জা দেখবেন এবং শহর ঘুরবেন। এ কারণে শুক্রবার রাত ১০টার দিকে জ্যোতি তার নিজস্ব প্রাইভেটকারটি নিয়ে বের হন। গাড়িতে পিয়াসার বোন তানজিলা, খালাত ভাইয়ের স্ত্রী আফরোজা তাবাসসুম তিথী, তার মেয়ে মানিজুর এবং জ্যোতির দুই বন্ধু হৃদয় ও শাহিন ছিলেন। তারা রাতে আলোকসজ্জা দেখে শহরে তাদের স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শহরের পালবাড়ি এলাকা থেকে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন।
ফেরার পথে রাত সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে যশোর শহরের পুরাতন কসবা শহীদ মসিয়ূর রহমান সড়কের (আকিজের গলি) পাশে থাকা একটি বিল্ডিংয়ের প্রাচীর ও বিদ্যুতের খুঁটিতে সজোরে আঘাত করে গাড়িটি। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান। গাড়িতে থাকা অন্যরা কমবেশি আহত হন।
শনিবার দুপুরে ইয়াশা ও পিয়াসাদের বাড়ি যশোর শহরের ঢাকারোড বারান্দিপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বিরাজ করছে শোকাবহ পরিবেশ। অশ্রুসিক্ত স্বজনরা একে অপরকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বাড়ির দ্বিতীয় তলায় খাটের ওপর শুয়ে বিলাপ করছেন ইয়াশা ও পিয়াসার মা রেহেনা আক্তার হিরা।
বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। চেতনা ফিরলে বিলাপ করে বলছেন একই কথা, ও আল্লাহ, তুমি আমারে কেন রেখে গেলে। আমাকে মা ডাকার তো আর কেউ থাকলো না। তুমি আমারে কেন নিলে না...! হিরাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা তাদের নেই।
যশোর কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শেখ তাসমীম আলম বলেন, শুক্রবার রাত একটার দিকে পুলিশ কন্ট্র্রোল রুম ও জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বর থেকে আমরা জানতে পারি, শহরের শহীদ মসিয়ূর রহমান সড়কে একটি প্রাইভেটকার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। পুলিশের রাত্রিকালীন দুটি টহল টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এরপর সেখানে আমিও যাই। ওই প্রাইভেটকারে তিনজন পুরুষ, তিনজন নারী ও একজন শিশু ছিল। ঘটনাস্থলে শহীদ মসিয়ূর রহমান সড়কের প্রাক্তন কাস্টমস সুপার জিএম কামালের বাড়ির প্রাচীর ও বিদ্যুতের খুঁটিতে সজোরে আঘাত করে প্রাইভেটকারটি। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণেই এই দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন শফিকুল ইসলাম জ্যোতি। তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন বিষয়টি। রাতেই তাকে আটক করা হয়। কাজেই আমরা ধারণা করছি, মদ্যপান করে বেপরোয়া গাড়ি চালানোয় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। জ্যোতি সুস্থ আছেন এবং গাড়িটি পুলিশ হেফাজতে রয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসএবি) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনায় আহত প্রাইভেটকার চালক শফিকুল ইসলাম জ্যোতিকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। তার ডোপ টেস্ট করা হবে। জ্যোতিকে কোতোয়ালী থানায় সোপর্দ করেছে। তাকে আদালতে চালান দেওয়া হবে।