Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ভারতীয় মিডিয়াতেও ফতুল্লার আকাশকে নিয়ে উচ্ছ্বাস

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ জুলাই ২০১৯, ০৬:১৯ PM
আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৯, ০৬:১৯ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আকাশ আহমেদ। তিনি উচ্চ শিক্ষিত কোনও অটোমোটিভ টেকনিশিয়ান নন। মাদরাসা থেকে ক্লাস নাইন পাস করা সাধারণ যুবক। সম্বল ছিল গ্যারেজে গাড়ির ছোটখাটো পার্টস তৈরি আর জাহাজের পাত কাটার অভিজ্ঞতা। আর ছিল ইউটিউবের টিউটোরিয়াল। বাড়ির সবাই যখন ঘুমাতেন, রাত জেগে জেগে একান্তে ইউটিউবে গাড়ি তৈরির টিউটোরিয়াল গুলোতে মনোযোগ দিতেন তিনি। সম্প্রতি ইতালির গাড়ি নির্মাতা ল্যাম্বরগিনির অন্যতম সেরা মডেল অ্যাভেন্টাডোর তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া দ্য ওয়াল 'তিন কোটির গাড়ি তিন লাখে, নাইন পাস আকাশ নিজেই বানিয়ে ফেললেন তার স্বপ্নের ল্যাম্বরগিনি' শিরোনামে একটি ফিচার করেছে। সেটি তুলে ধরা হলো-

বাবার গ্যারেজের গাড়ির যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলতে খেলতে আকাশ স্বপ্ন দেখত, বড় হলে সে নিজে একটা গাড়ি বানাবে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম লামাপাড়ার আকাশ আহমেদ। বাবা আর দাদা, দুজনেই গাড়ি মেরামতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছোট্ট আকাশ তার বাবা-দাদাকে কখনো দেখত ভাঙা গাড়ি মেরামত করতে। আবার কখনও কারও গাড়ির পার্টস পাল্টে দিতে।

আকাশ যখন একটু বড় হল, গ্যারেজে বা রাস্তায় চকচকে নতুন মডেলের কোনো গাড়ি দেখলেই তার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠত। এই বয়সের ছেলেদের বিভিন্ন দিকে আকর্ষণ থাকলেও আকাশের ধ্যান জ্ঞান ছিল শুধু গাড়ি। তার খুপরি ঘরের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো থাকতো বিশ্বের বিভিন্ন মডেলের গাড়ির রঙচঙে পোস্টার আর ক্যালেন্ডার।

গাড়ি গুলোর স্টিয়ারিং ধরে বসতে ইচ্ছে করত। কিন্তু গ্যারেজের মেকানিকের ছেলে হয়ে গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখাই উচিত নয়। কারণ এ স্বপ্ন পূরণের সামর্থ কোনও দিনই হবে না তার পরিবারের। বুকের কষ্ট বুকেই চেপে রাখত আকাশ।

স্বপ্ন দেখার দিনগুলি

একদিন একটা নতুন পোস্টার কিনে নিয়ে এলেন আকাশ। দেওয়ালে টাঙানো পোস্টারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। নীল পাখি যেন ডানা মেলেছে আকাশে। এক অবাস্তব সিদ্ধান্ত নিলেন আকাশ। ল্যাম্বরগিনি কেনার সামর্থ নেই যখন, গাড়িটি তিনি বানিয়েই নেবেন।

গাড়িটি ছিল ইতালির গাড়ি নির্মাতা ল্যাম্বরগিনির অন্যতম সেরা মডেল অ্যাভেন্টাডোর। যে গাড়ি বানাতে বছরের পর বছর হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ার মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছিলেন। সেই মডেলের গাড়ি নিজেই বানাবার স্বপ্ন দেখলেন আকাশ। তার  ইচ্ছা নিজের বানানো গাড়িতে করেই দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবেন।

একদিন সাহস করে বাবাকে বলেই ফেলেন। বাবা নবী হোসেন, গ্যারাজে খেলার ছলে ছেলের টুকিটাকি অথচ নিখুঁত মেরামতি  লক্ষ্য করতেন। মৃদু হেসেছিলেন বাবা। আকাশ বুঝলেন পেয়ে গেছেন বাবার সম্মতি। ছাদ ফুটো টিনের গ্যারেজই হল আকাশের ওয়ার্কশপ। কল্পনায় দেখতে থাকেন নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় সাঁই সাঁই করে ছুটছে তাঁর তৈরি ল্যাম্বরগিনি।

বাস্তবের জমিতে আকাশ 

বাবা এককালীন অর্থ দিতে পারবেন না। তাছাড়া কত খরচ পড়বে তাও আকাশ জানেন না। তাই বাবার কাছ থেকে রোজ একশ দেড়শো টাকা নিয়ে শুরু করলেন। শুরুতে বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে উৎসাহ না পেয়ে পেয়েছিলেন কটূক্তি আর উপহাস। কেউ কেউ বলতেন, গরীবের ঘোড়া রোগ হয়েছে। কিন্তু সেই সবে কান না দিয়ে, একমনে নিজের স্বপ্নকে রূপ দিতে থাকেন আকাশ। বাবার ও পরিবারের সমর্থন তার সাথে থাকায় কাজের প্রতি বাড়ে একাগ্রতা।

আকাশ অটোমোটিভ টেকনিশিয়ান নন। মাদ্রাসা থেকে ক্লাস নাইন পাস করা সাধারণ যুবক। সম্বল ছিল গ্যারেজে গাড়ির ছোটখাটো পার্টস তৈরি  আর জাহাজের পাত কাটার অভিজ্ঞতা। আর ছিল ইউটিউবের টিউটোরিয়াল। বাড়ির সবাই যখন ঘুমাতেন, রাত জেগে জেগে একান্তে ইউটিউবে গাড়ি তৈরির টিউটোরিয়াল গুলো গিলতেন আকাশ।

শুরু হলো রুপকথা 

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আকাশ শুরু করলেন গাড়ি তৈরির কাজ। জাহাজের পাত কাটার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ইস্পাতের পাত কেটে আসল ল্যাম্বরগিনির আদলে তাঁর গাড়ির বডি বানিয়ে ফেললেন আকাশ। তবে পয়সার সংকুলান না হওয়ায় আকারে অনেক ছোট করতে হল গাড়িটিকে। ইউটিউবের টিউটিরিয়াল দেখে আসল ল্যাম্বরগিনির আদলে  হেডলাইট, ব্যাকলাইট, গিয়ার, চাকার সাসপেনশন বানিয়ে ফেললেন একাই।

কাজটা শুনতে যত সহজ, বাস্তবে আদৌ ততোটা সহজ ছিল না। পূর্ণাঙ্গ গাড়ি তৈরির অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথম প্রথম আকাশকে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিছু একটা ভুল হয়ে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল।  বেশ কিছু টাকাও নষ্ট হয়েছিল সে কারণে। কিন্তু হাল ছাড়েননি আকাশ।

গাড়ির বডি তৈরির পর, গাড়িতে বসালেন ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিন। যাকে শক্তি যোগাবে পাঁচটি ব্যাটারি। ব্যাটারি পুরো চার্জড হতে লাগবে ৫ ঘণ্টা। টানা দশ ঘন্টা ৪৫ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারবে গাড়িটি। পুরো গাড়িটি আকাশ নিজের টিনের শিট ঘেরা ওয়ার্কশপে বানিয়েছেন। কেবল চাকা আর স্টিয়ারিংটি ছাড়া। ও দুটি কিনে নিয়েছিলেন, কারণ তার ওয়ার্কশপে ওগুলো বানানোর পরিকাঠামো ছিল না।

দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় ১৪ মাস। সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় ২৩ বছরের আকাশ বানিয়ে ফেলেছেন বিশ্বখ্যাত  ‘ল্যাম্বরগিনি’র অ্যাভেন্টাডোর সিরিজের আদলে, টু-সিটার একটি গাড়ি। খরচ পড়েছিল মাত্র ৩ লাখ টাকা। তবে তার তৈরি ল্যাম্বরগিনির কিছু ফিচার এখনও বাকি। যেমন সুইচের মাধ্যমেই দরজা খোলা ও বন্ধ করা। আকাশ এখন সেই কাজে মগ্ন। তিনি নিশ্চিত এই বাধাও তিনি জয় করবেন।

এবার দেশের মানুষদের জন্য গাড়ি বানাবেন আকাশ 

গাড়িটি বানানোর পর আকাশ দেশবাসীর কাছ থেকে বিপুল সাড়া পেয়েছেন। তাই আকাশ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, শুধু নিজের জন্যই নয়, এ বার দেশের মানুষের জন্য গাড়ি বানাবেন। এমনকি ইতিমধ্যে আরও ২৫টি গাড়ির তৈরির অর্ডার পেয়েছেন। তবে অন্যকারও কাছে তার প্রযুক্তি বিক্রি করবেন না আকাশ। তাই বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকাশ তার প্রযুক্তির পেটেন্ট চেয়েছেন। ভবিষ্যতে তিনি দেশের মানুষকে এক লাখ টাকায় গাড়ি উপহার দিতে চান।

তবে তারও আগে আরেকটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন আকাশ। এ বার নিজের প্রযুক্তিতে বানাবেন বিশ্বের সবচেয়ে দামী গাড়ি Bugatti La Voiture। আপাতত তারই নকশা আঁকা চলছে গ্যারেজের ওয়ার্কশপে। তবে এখন আর কেউ ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করেন না। কারণ আকাশ অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়ে দিয়েছেন। না থাকুক আসল ল্যাম্বরগিনির সব ফিচার, আদলটা তো এনেছেন।

ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম একবার বলেছিলেন, “স্বপ্ন পূরণ করতে হলে স্বপ্ন দেখা চাই। এবং সেই স্বপ্ন, যা আপনাকে ঘুমাতে দেবে না।” সত্যিই রাতের পর রাত ঘুমাননি আকাশ। তাই আজ নারায়নগঞ্জের রাস্তায় ডানা মেলেছে তার স্বপ্নের ল্যাম্বরগিনি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে বিশ্ব।

 

Bootstrap Image Preview