আমরা অতিমাত্রায় পরীক্ষানির্ভর হয়ে উঠেছি। কিন্তু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে উপায়ে পাঠদান চলে আর যে উপায়ে একজন পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়, তাতে একজন শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের পরিমাপ সম্ভব নয়। ‘পড়া গলধঃকরণ এবং পরীক্ষার খাতায় উদগিরণ’- এই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
পাঠ্য বা রেফারেন্স বই থেকে মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতা ভরিয়ে ফেলা কোনোভাবেই এই নিশ্চয়তা দেয় না যে ওই পরীক্ষার্থী সেই টেক্সট বা পাঠ বুঝতে পেরেছে; পড়া মুখস্ত নয়, আত্মস্থ করতে হবে। একটি টেক্সট মুখস্ত করতে পারা একমাত্র দক্ষতা নয়; টেক্সট ব্যাখ্যা করতে পারা এবং সেটিকে প্রয়োজনে অন্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারার সক্ষমতা অর্জন করা বেশি জরুরি।
অভিভাবকেরা তথাকথিত ভালো গ্রেড দিয়ে সন্তানের সাফল্যকে মূল্যায়ন করেন; ভালো গ্রেড নিয়ে পাস করলে তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন আর খারাপ করলে চিন্তিত হন। পৃথিবীতে অসংখ্য বেকার বা জীবনে ব্যর্থ মানুষ আছেন, যারা শিক্ষাজীবনে সেরা মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঈর্ষণীয় রকমের ভালো রেজাল্ট করেছেন। আবার এমন ব্যক্তির সংখ্যাও অগুণতি, যারা কোনোরকমে পাস করে কিংবা একেবারেই স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোতে না পেরেও জীবনে ঈর্ষণীয় উন্নতি করেছেন।
জীবনে সফল হতে হলে জীবন ও জগত সম্পর্কে নিবিঢ়ভাবে জানা জরুরি, জ্ঞানার্জন ও সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজেকে কর্মদক্ষ করে তোলা জরুরি; কেবল ভালো রেজাল্ট বা দামি সার্টিফিকেট কোনোভাবেই একজন শিক্ষার্থীর দক্ষতা অর্জনের মাপকাঠি হতে পারে না। আর কেবল ভালো রেজাল্ট করলেই সে ভালো ছাত্র বা ছাত্রী এবং ভালো ছাত্র বা ছাত্রী মানেই সে ভালো ছেলে বা ভালো মেয়ে আর ‘খারাপ ছাত্র বা ছাত্রী’ মানেই ‘খারাপ ছেলে বা খারাপ মেয়ে’ -এই মূল্যায়ন তো আরো হাস্যকর!
অভিভাবকদের উচিত, তাদের সন্তানেরা কতোটা শিখছে, সেদিকে মনোযোগী হওয়া; পরীক্ষায় কোন গ্রেড পাচ্ছে, তা নিয়ে উৎফুল্ল বা বিচলিত হওয়া খুব কাজের কথা নয়। জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি প্রতিনিয়ত শিখতে থাকলে একজন শিক্ষার্থী এমনিই জীবনে ভালো করতে পারবে, এজন্যে সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে পরীক্ষায় পাস করা জরুরি নয়।
অভিভাকদের তাই ভালো গ্রেডের জন্যে সন্তানদের ওপর চাপ তৈরি করা একেবারেই উচিত নয়; এই চাপের কারণেই অনেক সময় শিক্ষার্থীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও ভালো জানার পরও পরীক্ষায় খারাপ করে।
আর আশঙ্কার কথা হলো, গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়নের এই প্রবণতা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে দিন দিন জ্ঞানশূন্য করে তুলছে। ‘ভালো গ্রেড পেতেই হবে’ -চাপের কারণে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে কেবল পরীক্ষানির্ভর পড়াশোনার দিকে ঝুঁকছে। এ কারণে প্রায়ই আমরা দেখি, খুব ভালো প্রতিষ্ঠানের ভালো গ্রেড পাওয়া তথাকথিত সেরা শিক্ষার্থীরা আমাদের ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি ও জীবনের জন্যে জরুরি কিন্তু অত্যন্ত সহজ তথ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না। কেবল ভালো গ্রেডের মোহে অদূর ভবিষ্যতে আমরা যে একটি জ্ঞানশূন্য জাতি তৈরি করতে যাচ্ছি, তা এখনই উপলব্ধি করা দরকার; না হলে এই ক্ষতির ভার আমাদেরকেই সইতে হবে।
সহকারি অধ্যাপক; জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। লেখক ও গবেষক।
[email protected]