Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

জিপিএ ৫, সম্পত্তি না সম্পদ?

জুঁই জেসমিন
প্রকাশিত: ০৮ মে ২০১৯, ০৬:২২ PM
আপডেট: ০৮ মে ২০১৯, ০৬:২২ PM

bdmorning Image Preview


আপনাকেই বলছি, আপনার সন্তানকে আপনি কতটুকু সময় দিচ্ছেন? আপনার স্বপ্ন কি? সারাদিন কিসের পিছে, কিসের নেশায়  ছুটছেন? জিপিএ ৫ আপনার কাছে সম্পত্তি নাকি সম্পদ? যা অর্জনের জন্য সন্তানকে ছোটো থেকেই তুলে দিচ্ছেন প্রাইভেট মাস্টারের হাতে। এক হাতে বেতন দিয়ে কড়া কন্ঠে বলে দিচ্ছেন ছেলেমেয়ের আমার গোল্ডেন প্লাস চাই কি চাই। যেখানে জগতের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় পরিবার আর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বাবা মা, সেখানে সন্তানকে তুলে দেওয়া হচ্ছে বাণিজ্যধারী মাস্টারদের হাতে। এতে কতজন বাবা মা কতটুকু ফলাফল পাচ্ছেন?

সকাল হতে রাত আটটা পর্যন্ত আপনার সন্তান স্কুল ও কোচিং সেন্টারেই থাকে। আপনি কতটুকু সময় আপনার সন্তানকে কাছে পাচ্ছেন বা আপনার সন্তানেই আপনাকে কতটুকু পাচ্ছে। যে সময়টুকু একজন শিক্ষার্থী ফ্রি থাকে আপনারা থাকেন ভারতীয় চ্যানেলের পর্দায় বা স্মার্ট ফোনের জগতে। সন্তান থেকে আপনার দূরত্ব কতদুর ভেবে দেখুন। বেশির ভাগ গোল্ডেন প্রাপ্ত ছেলেময়েই বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছানোর আগেই কেন ঝরে যায়, যাচ্ছে? কেন বাবা মা হিসেবে আপনাদের দাম দিচ্ছেনা? একটাই কারণ বাণিজ্যিক শিক্ষকের প্রভাব, সন্তানদের সম্পূর্নরুপে তাদের ভরসায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

আপনি সম্পত্তি চান নাকি সম্পদ? এ সমাজে আপনার মতো কম বেশি প্রত্যেকটা নারী পুরুষ সম্পত্তি তথা অর্থ উপার্জনের ধান্ধায় থাকে, কি ভাবে চাকচিক্য বাড়ি হবে দামি গাড়ি হবে বিঘাবিঘা জমি হবে, দোকান হবে, কারখানা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

স্বপ্নটা সম্পত্তি দৌড়, ঠিক বিশিষ্ট 'ক' সমাজ সেবকের মতো শহরের উপর সাততলা বাড়ি, উপজেলার উপর সারি সারি দোকান যার নাম সজল মার্কেট। আবার গ্রামের বাড়িতে তো বেশ কয়েকটা আম বাগান, লিচু বাগান করা ছিলোয়। দুই ছেলে এক মেয়ের বাবা এই বিশিষ্ট মি: ক। 

ছেলেরা জিপিএ ৫ প্রাপ্ত তবে নামকরা নেশাখোর, যা মাতাল অবস্থায় পড়ে থাকে শহর বা গ্রামের অলিতে গলিতে। যে রাত দিনভর  লড়াই করে সম্পত্তি জোড়ানোর জন্য তার ছেলে নেশা না করবে তো কার ছেলে করবে?  সন্তানরা মানুষ হচ্ছে না অমানুষ হচ্ছে সে দিকে খেয়াল করার সময় নেই। দেখাশোনা করার মতো দু-চারজন শিক্ষক তো আছেই। আপনি সম্পত্তি জোড়ান আর আপনার ছেলে তা উড়াবে এটাই স্বভাবিক! কেননা কত কষ্টে সম্পত্তি গড়া হলো সে কথা ছেলেমেয়েদের তো বুঝতে দেওয়া হয়না।

সারাদিন রোদে পুড়ে ছেলে মেয়েকে টাকা পাঠানো হয় আর সেই টাকা অনেকের সন্তান কি করে, কি কি অকাজে নষ্ট করে তা জানার বাইরে। টাকা পাঠানোর সময় সন্তানকে বুঝতেই দেওয়া হয়না কত কষ্টে অর্জিত সেই টাকা পাঠানো হলো। আর এই নাজানাটায় বড় দোষ বাবা মায়ের। তারা তো ফুর্তি করবেই। সেই সন্তান কষ্টে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি ফাউল কাজে নষ্ট করবেনা যদি তাকে কষ্টের কথা গুলো শেয়ার করা হয়। কষ্ট, ত্যাগ, পরিশ্রম কি? তা ঠিক তারা অনুভব করে,এবং  ন্যায় কাজে অর্থ ব্যয় করে।  অর্থ বা সম্পত্তি মানব জীবনে এক বড় এলার্জি যা সবাই ধরে রাখতে পারেনা। অর্থ ধরে রাখার যোগ্যতা লাগে। তা হলো সন্তানকে  শিক্ষিত করে তোলা নয়, সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। 

যা হোক সম্পত্তি নিয়ে বেশি কথা টানছিনা সম্পদের কথা বলি....

আপনার ঘরে কোনো সম্পত্তি তেমন নেই, কিন্তু ফুটেফুটে দুটো সন্তান আছে। আপনি কি জানেন কত শত কোটি টাকার সম্পদ আপনার ঘরে? জানেন না। জানলে সম্পত্তির পিছে দৌড়াতেন না। সন্তানদের সময় দিতেন তাদেরকে সম্পদ হিসেবে আবিষ্কার করতেন।

এরিস্টটলের নাম শুনেছেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনকের কথা বলছি, যার এক হাজার লেখা দুশো বছর কবরে পুঁতা ছিলো। রোমের সেনাবাহিনী গ্রীস দখলের সময় তাঁর কবর থেকে তাঁরই হাতের লেখা পান্ডুলিপির সিন্দুক উদ্ধার করেন। এরিস্টটল মৃত্যুর সময় এক শিষ্যের হাতে রচনাসমূহ দিয়ে যান, সেই শিষ্য আবার তাঁর শিষ্যের হাতে তা তুলে দিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। এই শিষ্যের ছেলেরা শেষমেশ এরিস্টটলের সব লেখা তাঁরই কবরের পাশে লোহার সিন্দুকে ভরে মাটি চাপা দেন। এই হলো সম্পদ দু' শো বছর কবরে চাপা থাকার পরও উদ্ভার হয় যা আজ এরিস্টটলের নীতিবিদ্যা, অধিবিদ্যা নন্দনতত্ত্ব, বই সমুহ এবং তিনিই জীববিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ! সম্পদ চিরস্থায়ী আর সম্পত্তি অস্থায়ী, যা এই আছে এই নাই। 

যাহোক বিশ্ব পরিচিত রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী সাদি মুহাম্মদ স্যারসহ দেশ বরেণ্য আধুনিক গানের জনপ্রিয় শিল্পী সুবীর নন্দী ও শিল্পী মান্না দে, ভুপেন হাজারি, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, মমতাজের কথা বলছি, তাঁদের এ সুমিষ্ট কণ্ঠ বাপ দাদার সম্পত্তি ছিলো, নাকি তাঁরা সাধনা, বাসনা, সচেষ্টতায় নিজেকে সম্পদ হিসেবে আবিষ্কার করেছেন? এদের জীবনী ক'জন জানি আমরা, কোন অবস্থান থেকে কোন অবস্থানে এসেছেন, কিভাবে এসেছেন? অনেকেই জানিনা।

মমতাজ এলাকায় এলাকায় বয়াতি গান করে বেড়াতেন কত অভাব ছিলো! আজ তাঁরই গড়া নিজ নামে মমতাজ চক্ষু হাসপাতাল, আরও কত কি। আজ 'মোনালিসা'' ছবি  বিশ্ব দেয়ালে। এই ছবি আঁকতে আর ভাবতে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্জির কত বছর লেগেছিলো? তিন, তিনটে বছর লেগেছিল। তিন বছর ভাবনার ফসল। যার নাম 'মোনালিসা’।

যাহোক পুরনো যুগের কথা বলছিনা, বর্তমানের কথা বলছি; নেত্রকোনার সফিকুলের কথা বলছি, খুলনার লাবিবার কথা বলছি,ও ময়মনসিংহের সিঁথি সরকারের কথা বলছি যাদের বয়স মাত্র নয়, এই নয় বছরের শিশু কত লক্ষ টাকা উপার্জন করলো চ্যানেল আই 'গানের রাজা' বিশাল প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠানে সেরা বিজয়ী হয়ে?

সফিকুল যে ছেলে পরিবার চালায় মাঠে ঘাটে কাজ করে সে গানের রাজায় প্রথম খুলনার লাবিবা হলো চ্যাম্পিয়ন আর ময়মনসিংহের সিঁথি সরকার হয় দ্বিতীয়। এই সেরা তিন বিজয়ী সম্পর্কে নিশ্চয় জানেন, আর না জানলে গুগোলে সার্চ দিয়ে জেনে নিতে পারেন মাত্র নয় বছরের শিশু কোন পরিবার থেকে কত লড়াইয়ে নিজেকে দৃষ্টান্ত করলো অনন্য সফলতায়? যা আপনার শিশুটিও আজ পারতো।

মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব, মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব!  আপনি আপনার সন্তানকে সৃষ্টিশীল হিসেবে গড়ে তুলুন, জিপিএ ৫ অর্জনের আশায় নয়।
যন্ত্রবিদ টমাস আলভা এডিশন, যিনি রেল স্টেশনে স্টেশনে খবরের কাগজ, বাদাম চকলেট বিক্রি করতেন, আজ যে সারা বিশ্ব ঝলমলে আলো, তিনিই প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেছেন, আঁধার দূর করেছেন জগতের প্রতিটি ঘরের। তিনি এমন এক মহা উদ্ভাবক যাঁর একশোটির বেশি আবিষ্কার যা আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার, উপভোগ করে চলছি। আজ সেই বাদাম বিক্রেতা সেরা শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মধ্যে একজন টমাস আলভা এডিশন। প্রত্যেকের মাঝে সম্পদ আছে তা আমরা ঘোষা মাজা না করে গরীব ধনী নিয়ে মান অভিমান বা গর্ব করি, বাপের সম্পত্তি নিয়ে ফুর্তিতে মেতে উঠি। 

আমাদের গড়পড়তা স্বপ্ন, ছেলেমেয়ের  জিপিএ ৫ অর্জন, এ নিয়ে লড়াই ভাবনা প্রতিযোগিতা তুমুল। ভাবিনা সন্তানদের মৌলিক মেধা বিকাশের কথা, চাইনা তারা সৃষ্টিশীল হোক। এক একটি শিশুর মাঝে এক একরকম প্রতিভা আছে, প্রাইভেট কোচিং এর চাপে প্রতিভাগুলো গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে। 

অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো শিশু ভাঙা যন্ত্রপাতি ইলেক্ট্রনিক তার, শিশি বোতল, কাগজ বা টিন দিয়ে ফোন, গাড়ি, রেডিও বিভিন্ন জিনিস বানাই, এতে পরিবারের মানুষজন উৎসাহিত না করে বরং বাধা দিই, কটাক্ষ করে বলি মহাবিজ্ঞানী হচ্ছে পড়ালেখা বাদ দিয়ে। তার সাজানো, জড়ানো, স্বপ্নের সব জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে কান টেনে পড়ার রুমে নিয়ে আসা হয়। এটা কি আমরা ঠিক করি? মোটেও ঠিক করিনা। এ বাধাই তাদের চরম বিপর্যয়। আগের মানুষ শিক্ষিত ছিলোনা ঠিক কিন্তু সৃষ্টিশীল ছিলো আর এখন শিক্ষিত আর ভোগবাদী হয়ে ধ্বংসী হয়ে উঠছে। আমাদের উচিৎ সন্তানদের ইচ্ছে স্বপ্নকে প্রাধান্য দেওয়া তাদের সহযোগিতা করা মৌলিক আবিষ্কারক হিসেবে তৈরি করা, যা প্রজন্ম হতে প্রজন্ম সমাজের মঙ্গলে ব্যবহিত হয় তাদের সৃষ্টি -----!!!!  

মূলকথা.

নিজেকে এমন ভাবে আবিষ্কার করো
সম্পত্তি হিসেবে নয় সম্পদ হিসেবে
যাতে মৃত্যুর পরও সেই সম্পদের মালিকানা শুধু তুমিই থাকতে পারো, যা শত ইচ্ছে লড়াইও কেউ তোমার সৃষ্টি কর্মে 'আমার' শব্দটা বসাতে না পারে।

জুঁই জেসমিন,

লেখক ও মানবধিকার কর্মী, ঠাকুরগাঁও

[email protected]

Bootstrap Image Preview