আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একরৈখিক ভাবনায় পরিচালিত হচ্ছে; এখানে চিন্তার চর্চা কম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সহজাত চিন্তা ও ভাবনার প্রবণতা রয়েছে, তাকে এখানে নিরুৎসাহিত কেবল নয়, রীতিমতো দমন করা হয়।
এখানে সব শিক্ষার্থীকে এক ফর্মুলায় ফেলে কেবল পরীক্ষা পাসের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রবণতা (আসলে বলা ভালো ‘প্রতিযোগিতা’!) দৃশ্যমান; শিক্ষার্থীদের মনোজগতের গড়ন-গঠন ও ভাবনার জগতে যে বিভিন্নতা, সে সৌন্দর্যকে এখানে বিকশিত হতে দেয়া হয় না বরং অঙ্কুরেই তার মূলোৎপাটন করা হয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না।
তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ কী? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ হলো, সহজ কথায়, প্রকৃত শিক্ষা নিশ্চিত করা। যদি বলি, প্রকৃত শিক্ষা কী? প্রকৃত শিক্ষা হলো সেটি, যা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করে। আর যদি বলি, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মনকে একদিকে ধাবিত করে; খুব সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জীবনকে দেখতে শেখায়। কেবল পরীক্ষা পাস, সার্টিফিকেট অর্জন আর একটি চাকরি লাভকে বর্তমান সময়ে সাফল্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে; কতোজন শিক্ষার্থী ‘এ প্লাস’ গ্রেড পাচ্ছে, কেবল তার ভিত্তিতে একটি স্কুল বা কলেজের মান নির্ণয় করা হচ্ছে, পাস করা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অর্জন বিবেচনায় নয়। কেবল পাস করা আর চাকরি পাওয়া শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়; শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো একজন শিক্ষার্থীর মননের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন; পাশাপাশি তার শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনের স্বাস্থ্যের সঙ্গে শরীরের স্বাস্থ্যকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে; কেননা শারীরিক সক্ষমতা কিছু ক্ষেত্রে মনের বা মননের সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হবে শিক্ষার্থীর মনের প্রতিটি দিকের সম্প্রসারণ ঘটানো; শিক্ষার উপকরণ ও উপায় এমন হবে যা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে চিন্তাশীলতা, সৃষ্টিশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ ও বিশ্বমানবতার বোধকে উৎসাহিত করবে। এজন্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মিক শিক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে। আত্মিক শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেদেরকে জানার আগ্রহ ও সক্ষমতা দুটোই তৈরি হবে। শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষা পাস বা চাকরি নয় বরং জীবনের জন্যে প্রস্তুত করে তোলাই হলো শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য।
বড় কোনো পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া বা আশানুরূপ ফল না পাওয়ার কারণে প্রায়ই অনেক শিক্ষার্থী হতাশায় আক্রান্ত হয়, কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত নেয়। এর কারণ হলো, কেবল পরীক্ষা পাসকে ‘ভালো ছাত্র বা ছাত্রী’ হওয়ার প্রমাণ এবং সফলতার মাপকাঠি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আবার দেখা যায়, জীবনে চলার পথে কোনো বাধা বা সঙ্কটের সম্মুখীন হলে অনেকেই মুষড়ে পড়ে; ‘ভালো ছাত্র বা ছাত্রী’টিও। এর মানে হলো, কী করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাস করতে হবে, তা সে শিখেছে, কিন্তু জীবনের যে পরীক্ষা, তাতে ‘পাস’ করতে শেখেনি।
সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই আমরা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এর অর্থ হলো, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এসব ক্ষেত্রের সংকট থেকে উত্তরণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া চাই, যা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সৌহার্দ্য, শ্রদ্ধা আর সহনশীলতা নিশ্চিত করবে, ব্যক্তিকে ন্যায়পরায়ন করে গড়ে তুলবে। নিশ্চয়ই এমন শিক্ষার অভাব রয়েছে বলেই এসব ক্ষেত্রে আমরা বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত।
তাহলে আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা চাই, যা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের পাশাপাশি তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, মানবতাবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর সহনশীলতার উপস্থিতি নিশ্চিত করবে; এর পাশাপাশি তাদের মধ্যে তৈরি করবে দৃঢ় নৈতিক চরিত্র। আমাদের এখনই বোধোদয় জরুরি, ‘আয়োজনসর্বস্ব’ শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয়; এই বোধ শীঘ্রই জাগ্রত না হলে শিক্ষার সব আয়োজনই ব্যর্থ হবে।
সজীব সরকার: সহকারি অধ্যাপক; জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। লেখক ও গবেষক।
[email protected]