Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

স্কুলে পরিমল-মাদ্রাসায় সিরাজ: আমার বোনের নিরাপত্তা কোথায় করেছে বিরাজ?

মো: জামশেদুর রহমান
প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৪:৩২ PM
আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৪:৩২ PM

bdmorning Image Preview


স্কুলে পরিমল আর মাদ্রাসায় সিরাজ, আমার বোনের নিরাপত্তা কোথায় করেছে বিরাজ। ফেসবুকজুড়ে ক্ষুদ্রে বোনের চরম ক্ষোভ প্রকাশ। সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির নির্মম মৃত্যুতে পুরো দেশ ক্ষুব্ধ। হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছে দেশবাসী। রাস্তায় নেমেছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। তাদের হাতে রয়েছে বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুনে প্রতিবাদের ঝড়।

দিনের পর দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র চলছে নারীর প্রতি সহিংসতা। এ যেন কোনোভাবে থামতেই চায় না। নুসরাতের ঘটনা দেশব্যাপী জাতীর বিবেককে নাড়া দিয়েছে। মানুষ হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী। পূর্বের ফেলানী হত্যা, তনু হত্যা ছাড়াও দেশে আরো ব্যাপক আলোচিত ঘটনার দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের বিচার না হওয়ায় কেবল এইসব ঘটনার প্রসার ঘটেছে। এইসব ঘটনায় দেশবাসী হতাশ। কবে বন্ধ হবে নারীর প্রতি এইসব অবিচার। কেবল শঙ্কায় রয়েছে দেশবাসী। স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সুকুমার বৃত্তির বিকাশ হওয়ার কথা কিন্তু উল্টো সেখানে নির্যাতনের শিকার।

নুসরাতের ঘটনা ছাড়াও প্রতিদিন দেশে কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। শিশু থেকে শুরু করে কেউই ছাড় পাচ্ছে না নরাধম পশুগুলো হাত থেকে। তাদের শিকারে অনেকের অকালে প্রাণ হারাচ্ছে এভাবে প্রতিনিয়ত। আবার অনেকেই কলঙ্কের দাগ নিয়ে বেঁচে আছে।

দেশব্যাপী সবারই কম-বেশী জানা আছে স্কুলশিক্ষক পরিমলের কথা। ২০১১ সালের ২৮ মে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার পাশে একতলা ভবনের একটি কক্ষে ওই স্কুলের দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন পরিমল। এ ঘটনায় একই বছরের ৫ জুলাই ওই ছাত্রীর পিতা রাজধানীর বাড্ডা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। এতে পুলিশ পরিমলকে গ্রেফতার করে। মামলাটির চার বছর পরে রায় হয়। রায়ে শিক্ষক পরিমলকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ ও একইসঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে তাকে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। এইসব আলোচিত ঘটনার দ্রুত বিচার না হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা অনেকটা বেড়েই গেছে। ২০১৯ সালের এই পর্যন্ত ৪মাসে সারাদেশে আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাগুলোর মধ্যে নোয়াখালীতে ঘটেছে একাধিক ঘটনা।

গত ১৫ এপ্রিল নোয়াখালীর সেনবাগের উত্তর মোহাম্মদপুর গ্রামে ৪র্থ শ্রেণির এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় রাতে শিশুটির পিতা বাদী হয়ে ষাটর্দ্ধ এক ব্যক্তিকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় এলাকায় বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নির্যাতিতার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ওই শিশু পাশের বাড়িতে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলছিলেন। এ সময় পাশের বাড়ির আবুল বাসার মেয়েটির মুখ চেপে ধরে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। ভয় দেখানোর কারণে প্রথমে এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের কিছুই বলেনি নির্যাতিতা শিশু। পরে তার শারীরিক অসুস্থতা দেখে জিজ্ঞাসা করলে সে বিস্তারিত জানায়।

এ ছাড়াও গত কয়েকদিন আগে সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নের বসন্তপুর বাজারে নয় বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় জড়িত সিএনজি চালক রাজনকে (২৫) আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, নির্যাতিত শিশু স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। দুপুরে অসুস্থ বোধ করায় বিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল শিশুটি। পথে সিএনজির চালক রাজন শিশুটিকে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে গাড়িতে তুলে নেয়। পরে বসন্তপুর বাজারের একটি গ্যারেজে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে।এ সময় চিৎকারে স্থানীয়রা শিশুকে উদ্ধার করে এবং রাজনকে আটক করে।

এদিকে গত  ১ জানুয়ারী নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় স্বামীকে মারধর করে সন্তানসহ সবাইকে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখে এক গৃহবধূকে (৪০) গণধর্ষণ ও পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়।

এ দিকে এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কবিরহাট উপজেলায় তিন সন্তানের জননীকে গণধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। সিঁধ কেটে রাতে গৃহবধূর ঘরে ঢুকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তিন সন্তানসহ তাকে জিম্মি করে ধর্ষণ করে তিন ব্যক্তি। এরপর পালিয়ে যায় তারা। কবিরহাট উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের নবগ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

এ ছাড়াও সুবর্ণচর উপজেলার পূর্বচরবাটা ইউনিয়নে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৩) গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় এক অটোরিকশা চালক ও তার সহকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এই উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে ধর্ষণের শিকার এক গৃহবধূ বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। স্বামীর সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে দ্বন্ধের জেরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন গৃহবধূ। পরে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন তিনি। পরিবারের দাবি, রাতে ইউনিয়নের চর মাকসুম গ্রামে ধর্ষণের ঘটনার পর শনিবার সকালে ওই নারী বিষপান করেন।

এ  ছাড়াও সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র্র করে ছয় সন্তানের জননীকে গণধর্ষণের ঘটনায় চরজব্বার থানায় মামলা করা হয়। গণধর্ষণের শিকার গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত পাঁচজনকে আসামি করে চরজব্বার থানায় মামলা করেন।

এ দিকে চাটখিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা নিতে আসা অসুস্থ এক রোগীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আনোয়ার হোসেনকে আটক করেছে চাটখিল থানা পুলিশ। ওই নারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার আনোয়ার হোসেন চিকিৎসার নামে তাকে হাসপাতালের একটি কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করে। এ সময় রোগীর চিৎকারে হাসপাতালে থাকা রোগীর স্বজনসহ অন্যান্যরা ছুটে এসে আনোয়ার হোসেনকে আটক করে মারধর করেন। পরে চাটখিল থানা থেকে পুলিশ এসে আনোয়ার হোসেনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

অন্যদিকে কবিরহাট উপজেলার ধানশালিক ইউনিয়নে এক গৃহবধূকে (৩২) ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তার স্বামীর বন্ধুর বিরুদ্ধে। ওই গৃহবধূর ছোড়া মরিচের গুঁড়া ও দায়ের কোপে আহত হয়েছেন অভিযুক্ত মানিক (৩৮)।

এদিকে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রী।

এ ছাড়াও সোনাইমুড়ী উপজেলায় দুই সন্তানের জননী এক গৃহবধূকে আটকে রেখে রাতভর গণধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পুলিশ দুইজনকে গ্রেফতার করেছে।

এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর ইউনিয়নে এক কিশোরীকে (১৪) ঘুম থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় শিরিন আক্তার পাখি (২৫) নামে এক নারীকে গ্রেফতার করলেও ঘটনার মূল আসামিরা পলাতক রয়েছে।

এদিকে চাটখিলে নিজের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতা শহিদ উল্যাহকে (৪০) গ্রেফতার করে পুলিশ। উপজেলার পাঁচগাও ইউনিয়নের নিরবর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে উদ্ধার করে ডাক্তারী পরীক্ষার জন্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়।

জানা গেছে, কয়েক বছর আগে শহিদ উল্যাহর স্ত্রী মারা যায়। এর পর তিনি ছোট মেয়েক (১৬) নিয়ে নিজ বাড়িতে থাকতেন। বাড়িতে মেয়েকে একা পেয়ে প্রায় সময় ধর্ষণ করতেন। বিষয় কাউকে বললে মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দিতো শহিদ। কিন্তু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় মেয়েটি তার বোনকে ঘটনা জানায়। এরপর ধর্ষিতার বড় বোনের জামাই চাটখিল থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে পুলিশ অভিযুক্ত শহিদ উল্যাহকে গ্রেফতার ও মেয়েটিকে উদ্ধার করে।

পর পর নোয়াখালীতে ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। আর এইসব ঘটনায়গুলো রোধে ধর্ষকের বিচারের রায় অনেক ধীরগতিতে হওয়ায় এসব অপরাধের পরিমাণ আরো কেবল বেড়েই যাচ্ছে। তাই যদি দ্রুত বিশেষ ক্ষমতা আইনে মাধ্যমে মামলার দ্রুত বিচার কাজ সম্পাদন করা হতো তাহলে অনেকটা কমে যেতো। তাই এইসব বিষয়গুলো সরকারকে গুরুত্ব সহকারে আমলে নেওয়া উচিত।

আর ধর্ষণ রোধে সরকারকে আইনের আরো কঠোরতা বাড়ানো দরকার। যারা ধর্ষণের সাথে জড়িত হবে তাদের দ্রুত তম সময়ের মধ্যে বিচারের রায় হলে অন্যরা এইসব থেকে পিছু হঠবে। আর ধর্ষণের ঘটনাও অনেক কমে যাবে। এ ছাড়াও দেশবাসী সবাইকেও সরকারের পাশাপাশি এইসব অপরাধ রোধে কাজ করতে হবে। সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলেই এইসব ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।

 

লেখক- মো: জামশেদুর রহমান

প্রতিনিধি, বিডিমর্নিং

Bootstrap Image Preview