Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

ছোটগল্প : ‘নদীর স্রোতে বৈশাখ’

নাসিম আহমেদ রিয়াদ
প্রকাশিত: ১০ এপ্রিল ২০১৯, ০৭:৪৮ PM
আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৯, ০৭:৪৮ PM

bdmorning Image Preview


খুব ছোট একটি গ্রাম যেখানে মাত্র ১৫০জন মানুষের বসবাস। একদম নিস্তব্ধতা সম্পূর্ণ গ্রাম। গ্রামের পাশেই একটি ছোট্ট নদী প্রবাহিত হয়েছে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে গেছে কাচা সড়কের রাস্তা। পুরো গ্রামের মানুষের অর্থ উপার্জনের একমাত্র পথ হলো তাঁত শিল্প। গ্রামটাতে ২টা গোষ্ঠী নিয়ে একটা সমাজে বিভক্ত। নদীর ধার দিয়ে নিম্ন শ্রেণী মানুষের বাস যারা ক্ষুধা নিবারণ করার জন্যে প্রতিনিয়ত তাঁতের কাজে লিপ্ত হয় তারা। গ্রামে কোন মেলা হয়না কারণ গ্রামে শুধু মুসলমানের বসবাস। তাই সকল শ্রেণীর মানুষ উৎসব হিসাবে বেছে নিয়েছে পহেলা বৈশাখকে গ্রামের একমাত্র স্কুলে হয় মেলাটা পুড়ো মাস ব্যাপী প্রত্যেক শনিবার মেলা। এতে অংশগ্রহণ করে আশে পাশের গ্রামের মানুষ সহ প্রত্যেক বাড়ীতে বাড়ীতে মেহমান দিয়ে ভরপুর হয়ে থাকে সে ধনী হোক কিংবা গরীব। গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা আগে থেকেই তাঁতের কাজ করে মেলার জন্যে। মেলাতে ছেলে মেয়েদের জন্যে নিজেরাই তৈরি করে থাকে বৈশাখী শাড়ী, শিশুদের জন্যে গেঞ্জি, এবং বড়দের জন্যে পাঞ্জাবী। গ্রামের নদী ধারে একটি কুঁড়ে ঘর আছে, ঘরের উপরেই একটা বটগাছ। বটগাছের নিচে খেলা করছে, স্কুল পড়ুয়া তিন ছেলা নাম মিশুক, হিরা এবং মুক্তা। হিরার বাবা অনেক ধনী মানুষ নিজেরই তাঁত কারখানা আছে যেখানে প্রায় ৮০জন শ্রমিক নিয়জিত থাকে। মিশুক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে এবং মুক্তার বাবা মারা গেছে যখন ওর বয়স ২ বছর। ওর শুধু মা আছে, পরের বাড়ীতে কাজ করে। মুক্তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তিনজন খেলা করতে করতে মিশুক বলল, ‘মুক্তা আর পনেরো দিন পর মেলা, তুই কি কিনবি?’

- এখনো কিছু ঠিক করিনি। মা মনে হয় কি করে।

হিরা কিছুনা বলে শুনছে, হঠাৎ বলে উঠলো, ‘নদীর উপারে যাবি, চল তরমুজ খেয়ে আসি।’

- হিরা বলল নারে আমি যামু না তোরা যা, বাবা শুনলে গালি দিবে।

এই বলে হিরা বাড়ীর দিকে রওনা দিলো আর মিশুক এবং মুক্তা নদীর ভিতরে নামতে লাগলো। নদীতে নামতেই মুক্তা বলল, ‘দেখে ঘাটে একটা ব্যাগ পড়ে আছে একদম কালো রং এর।’

- চলতো দেখি

মিশুক তাড়াতড়ি গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিলো। এই সময় মুক্তা বলল, ‘কেউ মনে হয় ভুলে রেখে গেছে ব্যাগটা নিয়ে চল বটতলা যা দেখি কার ব্যাগ।’

এই বলে ওরা দুজন বট গাছের দিকে রওনা দিল। ওরা দুজন বট তলাতে বসে ব্যাগ খুলতেছে। মুক্তা বলল, ‘এই দেখ মিশুক ব্যাগের ভিতর কেমন ছোট জামা কাপড়? প্রত্যেকটা জামার উপরে নকশা ইলিশ মাছের ছবি, ঢোল, ঘুড়ি!’

- আমি মাকে গিয়ে বলবো মা আমাকে একটা কিনে দিবে, এবারের বৈশাখে।

- আমিও বলবো এখন চল যাই ব্যাগটা যেখানে ছিলো রেখে আসি।

ওরা দুজন ব্যাগটা রেখে এসে যার যার মতন বাড়ি চলে গেল।

রাত্রিতে ঐ কুঁড়েঘরের মধ্যে চৌকিতে শুয়ে আছে মুক্তার মা রাহেলা এবং মুক্তা, মেঝেতে জ্বলছে হারিকেন এর আলো।

- মা আর দুদিন পর তো বৈশাখ, আমি অনেক দিন ধরে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খাইনা।

- আমাদের মতো গরিবদের কি এই গুলা মানাই বল?

- মা আমাকে একটা বৈশাখী গেঞ্জি কিনে দিবি। না কিনে দিলে কিন্তু স্কুলে যামুনা।

এই বলে মুক্তা ঘুমিয়ে পড়লো। মার চোখে আর ঘুম আসছে না ছেলের আবদার, তাও আবার বাপ মরা ছেলে। কাল মহাজনের কাছে একবার যাইতেই হয়।

- সকাল হতে না হতেই রাহেলা মহাজন এর কাছে গিয়ে হাজির। মহাজন তামাকের হোক্কা খাচ্ছে সিঁড়িতে বসে।

- মহাজন সাহেব, আমার টাকাটা একটু যদি দিতেন কাজের টাকাটা।

- এইতো সামনে সপ্তাহে টাকা দিলাম। আরও দু এক সপ্তাহ যাক তার পরে দিবোনি।

- মহাজন সাহেব টাকাটা দিলে খুব উপকার হবে? কাল বৈশাখ ছেলেটা ভালো মন্দ খেতে ছেয়েছে বুঝেনিতো, বাপ মরা ছেলেটা। একটা গেঞ্জি না কিনে দিলে স্কুলে যাবেনা।

- দেখ রাহেলা এসব বাদ দিয়ে ছেলেটাকে আমার তাঁতের কাজে লাগিয়ে দে, তোর সংসারও চলবে। এই সব ন্যাকামি বাদ দে?

- রাহেলার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, মহাজন আমার টাকাটা দিন না, আমি কাজ করে দিয়ে শোধ করে দিবো।

মহাজন অনেক কথা বলছে টাকা দিচ্ছেনা। এমন সময় মহাজনের বউ এসে হাজির। মহাজনের বউটা অনেক ভালো মনের মানুষ।

- কিরে রাহেলা কি হয়েছে?

- দেখেন না ভাবি মহাজনরে একটু টাকা দিতে বলুন।

- আই আমর ঘরে? আমি দিচ্ছি।

মহাজনের বউ ঘর থেকে ৫০০ টাকা দিলো। রাহেলা অনেক খুশি মনে চলে গেল।

রাহেলা টাকাটা নিয়ে বড়হর হাটে যাচ্ছে ছেলের আবদার মিটানোর জন্যে, একটাই আবদার করেছে নতুন জামা পড়বে না ফলে কি হয়।

রাহেলা বাজার থেকে নতুন জামা, বাজার করলো বৈশাখের সব। বাড়ী গিয়েই..

- মুক্তা এইযে সব নিয়ে এনেছি, নি গেঞ্জিটা পর, দেখ কেমন হয়ছে?

- না মা এখন পড়মু না কাল পড়ুমনি, এখন পরলি নতুন তা নষ্ট হয়ে যাবে।

মুক্তা বার বার এসে গেঞ্জিটা দেখে কিন্তু পড়ছেনা নতুন নষ্ট হয়ে যাবে ছোট ছেলেদের মন। রাত্রি শেষ হয়ে সকাল হতেই ঘুম থেকে উঠে রাহেলা উঠান পরিস্কার করে রান্না করতে শুরু করলো। মুক্তা আজ অনেক খুশি অনেক দিন পর ভালো রান্না করছে মা।

সকাল হতে না হতেই মিশুক হিরে এসে হাজির

- হিরা বলল এ মুক্তা গোসল করতে যাই, নদীতে গোসল করে এসে ঘুরতে যামু নতুন জামা পড়ে?

এই বলে ওরা তিনজন গোসল করতে গেল...

প্রতিদিনের মতোই গোসল করতে গেলা, ওরা নল নল খেলছে, ওরা সাঁতার কটাছে তিনজন। নদীতে প্রখর স্রোত হঠাৎ দেখতে মুক্তা আর নেই। ওরা দুজন অনেক ডাকছে কিন্তু মুক্তাকে পাচ্ছেনা। স্রোত এসে মুক্তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। মুক্তার আর নতুন জামা পড়া হলনা, হলনা বৈশাখের রান্না খাওয়া।

মুক্তার খবর পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নদীর ধরে আহাজারি কে দেখে তার একটাই ছেলে। আল্লাহ তায়ালা সবার কপালে সব রাখেনা।

Bootstrap Image Preview