লোহা-পেরেকের সাথে হাতুড়ির ঠুকঠুকানি আর করাতের শব্দ কানে ভেসে আসছে। বাচ্চু মিয়া করাত হাতে খুঁটির সঠিক মাপ দিতে ব্যস্ত। কাজের তড়িঘড়িতে কথা বলায় যেনো দায় হয়ে পড়লো। বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সুযোগ হলো কথা বলার।
প্রায় আট-দশ বছর ধরে তিনি বই মেলার প্রস্ততিকালীন সকল কাজ করে থাকেন। প্রায় একশোর মতো প্যাভিলিয়নের কাঠামো দাঁড় হয় তার হাত দিয়ে। মেলা শুরু হওয়ার মাস দেড়েক আগ থেকেই রাত-দিন কাজ করে যান। তবে মেলা শুরু হয়ে গেলে আর আসেন না। স্টল গড়ার কাজ খুব নিখুঁত হলেও নিজের নাম লিখতে গেলে পড়েন লজ্জায়, সেখানে বই পড়া তো অনেক দূরের বিষয়। ছোটবেলায় স্কুলে গিয়েছিলেন কিনা সে কথাও ঠিক মনে নেই।
‘এই ধরেন দশ বছর ধইরা এইহানে খুঁটি গাড়ার কাজ করি তয় বই পড়িনি কহনো। মেলা শুরু হইয়া গেলে আমরা আর আসি না। এটা যে বই মেলা সেটা জানি, কিন্তু এখানে কি হয় সে নিয়া আমি কিছু জানি না। আমাদের ডাক পড়লে আইসা কাম কইরা দেই তাতে টেকা পাই আর আমগো কাম শেষ। মোদ্দাকথা মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্তই আমগো কাম।‘
শুধু বাচ্চু মিয়া নয়, তার মতো প্রায় সকল শ্রমিক-কারিগরদেরই একই অবস্থা। বছরের পর বছর ধরে বই মেলায় স্টল নির্মাণের কাজ করলেও এখনো অব্দি জানেন না এই মেলায় কি হয়, কিংবা বই মেলা বলতে কি বোঝায়!
স্টল নির্মাণে কর্মরত আরেক শ্রমিক নাজমুল শিকদার বলেন, 'আমি ড্রাইভারি করি। কয়দিন হাতে কাজ নাই তাই এই কাজ হাতে নিলাম। একটা মেলা হইবো জানি, কিসের তা বলতে পারবো না।'
শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বরমুখী সড়কজুড়ে পুরোটায় এই ঠুকাঠুকির শব্দ। কারিগরদের তড়িঘড়ি সাথে চোখে পড়ে বাঁশ, কাঠ আর বাহারি রঙের কৌটা।
বছর ঘুরে আবারও আসছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আবারও মিলন মেলায় পরিণত হবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। প্রতিবারের মতোই এবারও ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে আয়োজন করা হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সপ্তাহ দুয়েক ঘুরলেই দ্বার খুলবে সেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮। একুশ আর একাত্তরের চেতনায় ঋদ্ধ এ মেলাকে ঘিরে তাই বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এগিয়ে চলছে সব ধরনের প্রস্তুতি। দাঁড়িয়ে গেছে অধিকাংশ স্টলের কাঠামো।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, পুরোদমে শুরু হয়েছে স্টল স্থাপনের কাজ। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই তাদের স্টলের পজিশন বুঝে পেয়েছে। এখন চলছে স্টলের কাঠামো দাঁড় করানোর কাজ। কাঠামো দাঁড়ালেই শুরু হবে সাজসজ্জার আয়োজন।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রথমবার বইমেলার আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই আয়োজিত হয়েছে বাঙালির এই প্রাণের মেলার। এখন সাংস্কৃতিক উৎসব ও মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এটি। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলা একাডেমির পাশাপাশি শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত প্রশস্ত হয়েছিল মেলা। এবারও বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসছে মেলা।
পুরোদমে প্রস্তুতি চলছে মহান একুশে বই মেলার। বাংলা একাডেমি প্রস্তুত হচ্ছে সারা বাংলাদেশের বই প্রেমীদের বরণ করে নিতে। পুরোদমে পস্তুতি চলছে ‘অমর একুশে গ্রন্থ মেলার’। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক দোকান বরাদ্দের জন্য দরপত্র জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন ঘুরে দেখা যায়, চলছে মঞ্চ ও অস্থায়ী স্টল নির্মাণ।
বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার মেলার পরিধির সাথে সাথে স্টলের পরিমাণ বাড়ছে, নতুন বইয়ের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাই মানের দিকে বেশি জোর দিয়ে যথাসময়ে কাজ শেষ করার ইচ্ছা পোষণ করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ।
তিনি বলেন, 'বিজয় ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ নবোপর্যায় এই থিম নিয়ে এবারের বই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। মেলার সার্বিক রুপসজ্জায় এই থিম ব্যবহার করা হবে। তাছাড়া এবারের মেলায় ৪ হাজারের মতো নতুন বই আর ৮৫০ টি মানসম্পন্ন বই থাকবে। প্রকাশক-লেখক ও পাঠকদের সর্বোপরি অংশগ্রহণমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে এবারের মেলা নতুন করে প্রাণ পাবে।'
গত বছরে বই মেলায় সবথেকে আপত্তিকর যে বিষয়টি ছিল তা হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে বসার ব্যবস্থা ছিলো না। এবারে সেই প্রতিবন্ধকতা কাটাতে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিডিমর্নিংকে বলেন, 'এবারে নতুন করে স্বাধীনতা চত্বর ও সাথের জলাধারকে মেলার সীমারেখার মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। সেখানকার বসার সিটগুলো তাই আপনা-আপনি মেলার ভেতরেই পড়ছে। তাছাড়া বসার জন্য আলাদা করে ব্যবস্থা রাখা হবে। তাছাড়া বরাবরের মতো নিরাপত্তার বিষয়টা গুরত্ব সহকারে দেখে নাগরিক সকল সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।'
তাছাড়া শিশু চত্বরের ডিজাইনে কাজ করছেন শিল্পী সব্বোসাচী হাজরা এবং কার্টুনিস্ট মেহেদি হক। আর পুরো মেলার দায়িত্বে রয়েছেন আর্কিটেকচার এনামুল কবির নির্ঝর।
ইউনিট, প্যাভিলিয়নসহ অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ায় এবারের মেলায় বাংলা একাডেমিসহ বাড়ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিসর। এবারের এই প্রাণের মেলা বৃহৎ পরিসরে অনুষ্ঠিত হওয়ায় প্রতি বছরের তুলনায় এবার পাঠক সমাগম বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
একটা দীর্ঘ সময় অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে টিকে আছে বাংলাদেশ৷ আর এতে একুশে বইমেলার একটা প্রভাব দেখছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী।
ইতিহাস টেনে বলা যায় পৃথিবীতে বাঙ্গালীই একমাত্র জাতি যারা প্রাণ দিয়েছে মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য। ১৯৫৫ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলা একাডেমি। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রয়ারি মুক্তধারার চিত্ত রঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির সম্মুখভাবে কিছু বই নিয়ে বসেন। তারপর থেকে বীর ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর সম্প্রসারিত হতে থাকে একুশে বই মেলা।
১৯৮৪ সালে বই মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। গ্রন্থ মেলায় বাঙালি তার বীর ভাষা শহীদদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালবাসায়। ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগ ও বাঙালি তার ভাষা শহীদদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কারণে জাতিসংঘ ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করেন। ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বর্তমানে বাঙালির প্রাণের মেলা হিসেবে রূপ লাভ করেছে।