গণমাধ্যমের খবরের মাধ্যমে এদেশের মানুষ নতুন করে পরিচিত হয়েছে ‘খাট’ নামক এক ধরনের মাদকের সাথে। মুলত এই মাদকদ্রব্যটি দেখতে খানিকটা গ্রিন টি এর মতো। গ্রিন টি এর মতো দেখতে হওয়ায় এটি দেশের বাহিরে থেকে বাংলাদেশে আমদানি হতো গ্রিন টি হিসেবেই। আর সব কিছু জেনে শুনেই গ্রিন হিসবে এই মাদকটি ছাড়পত্র দিতেন আব্দুল আজিজ নামে একজন। ৩ বছর ধরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্ল্যান্ট কোয়ারাইন্টাইন (উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিভাগ) ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান পদে কর্মরত। গত বুধবার রাতে তিনি যে বিমানবন্দরে কর্মরত, সেখানেই ১ কেজি ৬শ গ্রাম চোরাই স্বর্ণসহ আটক হয়েছেন। তারপর থেকে একে একে বেড়িয়ে আসছে তার দ্বারা সম্পাদিত নানা অপকর্মের ইতিহাস।
জানা গেছে, স্বর্ণের আন্তর্জাতিক চোরাকারবারে যুক্ত তিনি। সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে অবৈধভাবে উপরোল্লিখিত পরিমাণ স্বর্ণ নিয়ে আসছিলেন। আব্দুল আজিজের সঙ্গে তারই সিন্ডিকেটের আরেকজনকেও আটক করা হয়েছে। তিনিও একসঙ্গে সৌদি থেকে ফিরছিলেন, নাম মোলাম মিয়া।
এর পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে কেউটে সাপ। চাকরিতে কর্মরত থাকাকালে গত তিন বছরে আব্দুল আজিজের দেওয়া সনদে মণকে মণ নতুন মাদক ‘খাট’-এর চালান ছাড়ানো হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে। নতুন এ মাদকের কারবারিদের সঙ্গেও সম্পৃক্ত আজিজ।
স্বর্ণ আটকের ঘটনায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে আব্দুল আজিজ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ঢাকার বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেছে। সহযোগীসহ আজিজ বর্তমানে থানা পুলিশের হেফাজতে আছেন। আজ শুক্রবার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাদের আদালতে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
ঢাকা কাস্টমস হাউস ও পুলিশ সূত্র জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনস্থ একটি উইং প্ল্যান্ট কোয়ারাইন্টাইন উইং। রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়িতে সংস্থাটির মূল অফিস হলেও বিমানবন্দরেও এর পৃথক একটি কার্যালয় রয়েছে। এ অফিসের ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান হিসেবে এতোদিন কর্মরত ছিলেন আজিজ। তাদের কাজ হলো বিদেশ থেকে আসা সকল প্রকার ফলমূল এবং উদ্ভিদজাতীয় পণ্যের ‘সংগনিরোধ প্রত্যয়নপত্র’ দেওয়া।
বিদেশ থেকে আসা ফলমূল ও উদ্ভিদ কোনো জীবাণু বা রোগবালাই নিয়ে যেন দেশে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা প্ল্যান্ট কোয়ারাইন্টাইন উইংয়ের কাজ। তাদের প্রত্যয়নপত্র প্রাপ্তিসাপেক্ষে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়ায় পণ্যের শুল্ক কর আদায় করে। আব্দুল আজিজ গত ৩ বছরে বিমানবন্দর অফিসের প্ল্যান্ট কোয়ারাইন্টাইন উইংয়ে কর্মরত টেকনিশিয়ান হিসেবে নতুন মাদক খাটের ছাড়পত্র দিয়েছেন গ্রিন-টি হিসেবে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অজান্তেই বেরিয়ে গেছে অসংখ্য খাটের চালান।
জিজ্ঞাসাবাদে আব্দুল আজিজ তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানান, প্রতি চালানের সনদ দিয়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। তাকে আশ্রয় দিতেন বিমানবন্দরে কর্মরত একজন প্ল্যান্ট কোয়ারাইন্টাইন উইংয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তার নাম কেবিডি. মো. হাফিজুর রহমান। আজিজের দেওয়া টেস্ট রিপোর্ট সনদে স্বাক্ষর করতেন তিনি। যদিও অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কেবিডি. মো. হাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমি’তো আর টেকনিশিয়ান না। আব্দুল আজিজ কাঁচামাল পরীক্ষা করে যে রিপোর্ট তৈরি করে দিতেন আমি সেই রিপোর্টে স্বাক্ষর করতাম মাত্র।
সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আরও তথ্য জানতে আব্দুল আজিজকে আগামী সোমবার সিআইডি পুলিশের সদর দপ্তরে তলব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মো. হাফিজুর রহমান।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, আব্দুল আজিজ টেকনিশিয়ান হলেও তিনি বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যেদিন তিনি স্বর্ণসহ আটক হন সেদিন বিমানবন্দরে তার কোনো ডিউটিই ছিল না। তবু ডিউটি পাস নিয়ে তিনি স্বর্ণের চোরাচালানটি খালাসের চেষ্টা করেছিলেন। আটকের সময় তার কাছ থেকে জব্দকৃত মোবাইল ফোনে আরেক আটক যাত্রী মোলাম মিয়ার ছবি ও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। আটকের পর থেকে আজিজের সেল ফোনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধ পণ্যের চালান সরবরাহ সংক্রান্ত কল আসছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও তার মোবাইল ফোনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি কল এসেছে। যাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো তাদের বিষয়ে বিশদ জানার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. মুক্তারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসছে সাপ! বিশদ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে শুক্রবার (আজ) তাদের আদালতে পাঠানো হবে। এ চক্রে যারা জড়িত, তাদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘খাট’ বা ‘মিরা’ নামে এই উদ্ভিদটি নিউ সাইকোট্রফিক সাবস্টেন্সেস বা এনপিএস নামে পরিচিত। অনেকে একে ‘আরবের চা’ বলে থাকেন। যেটি কিনা আন্তর্জাতিকভাবে 'সি' ক্যাটাগরির মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। টুকরো টুকরো সবুজপাতা। দেখে অনেকেই গ্রিন টি ভেবে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। একমাত্র বিশেষজ্ঞের চোখই বলে দিতে পারে, যে এটি কোনো চা বা সাধারণ পাতা নয়। এই হল নতুন ধরনের মাদক ‘খাট’। মাদকসেবীরা এ পাতাটিকে চিবিয়ে বা পানিতে ফুটিয়ে চায়ের মতো খেয়ে থাকে। ভেষজ এ উদ্ভিদটি অন্যান্য প্রাণঘাতী মাদকের মতোই ভয়ঙ্কর বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।