Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

মুক্তিযোদ্ধা সাবুর গাজীর বীরগাথা স্মৃতিচারণ

মীর খায়রুল আলম, দেবহাটা (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি 
প্রকাশিত: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৬:১৬ PM
আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৬:৩২ PM

bdmorning Image Preview


সময় ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ডাকে সাড়া দিয়ে ১৭ বছরে ৮ম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশ রক্ষায় উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের কোঁড়া গ্রামের মৃত.দীন আলী গাজীর ছেলে বীরমুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে গঠিত ৯নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনীতে নাম দেন তিনি।

পাকিস্তানিদের অত্যাচার যতই দিনে দিনে বাড়তে থাকে ততই নিজের ভিতর মুক্তিকামী চেতনা জাগতে থাকে। আর তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে ইন্ডিয়ার টাকিতে এবং তকিপুর ট্রেনিং সেন্টারে ২ মাস প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে ১ম ব্যাটালিয়ন গ্রুপ গঠন হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সুবহানকে এই গ্রুপের জেসিও করে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণি, গোলাম হোসেন, নুরুল হক, আবু মুছা, এটিএম জামাত আলী, গোলাম রব্বানী, আব্দুল হাকিম ঢালীসহ আরো কয়েকজন।

ট্রেনিং শেষে বাড়ি ফিরেই বিভিন্ন স্থানে মাইন বসিয়ে রাতের আধারে আবারো ভারতের টাকিতে চলে যায় তারা। সেখানে আবারো বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় তাদের। এ সময় তাদের সাথে প্রশিক্ষণ নেয়া উপজেলার নারিকেলী গ্রামের আবুল কাশেম নামের একজন তাদের সাথে ঘাটিতে অবস্থান করছিল।

কয়েক দিন পর আবুল কাশেম ট্রেনিং ঘাটি থেকে পালিয়ে দেশে এসে যোগ দেয় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে। বিষয়টি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্ক বাড়তে থাকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে। এরপর ৯নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা ও সাব-সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান মাস্টার ১নং ব্যাটেলিয়নকে নির্দেশ দেন তাকে ধরে আনার জন্য। তাই তারা সোর্স দিয়ে প্রতিনিয়ত আবুল কাশেমের তথ্য নিতে থাকেন।

৭১- এর অগ্রহায়ণ মাসের এক রাতে আবুল কাশেম বিয়ে করে বৌ নিয়ে বাড়িতে ফেরে। খবর পেয়ে জেসিও আব্দুল সুবহানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দলটি ৩টার দিকে তার বাড়ি ঘেরাও করে। সারা রাত বাড়ির চারিপাশে অবস্থান করেন তারা। পরদিন সকাল ৬টার দিকে আবুল কাশেম ঘরের বাহিরে আসলে তাকে দাঁড়াতে বললে ধান ক্ষেতের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় বাহিনীর সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী করা একটি গুলি তার গলার নিচে ঢুকে পড়ে। এতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের কাছে থাকা গামছা দিয়ে তার গলায় পেচিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেন তারা। পরে তাকে ৫/৬ জন মিলে কাধে করে নিয়ে যায় ইছামতির পাড়ে। এ সময় সাব-সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান মাস্টার তাকে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দিলে গোপাল গণি এসএমজি স্টেন গান দিয়ে উক্ত রাজাকারকে চিরতরে খতম করে।

পিস কমিটি ও হানাদারদের তৎপরতা:

ধীরে ধীরে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকায় পিস কমিটি গঠন করে। কমিটির মাধ্যমে প্রতিটি এলাকায় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির নেতারা প্রতিটি এলাকার বাড়ি থেকে একজন একজন করে লোক নিয়ে খান সেনাদের বাংকার (মাটি খুঁড়ে যুদ্ধের বিশেষ ঘর) নির্মাণ করে নিত।

সারা দিনের কাজ শেষে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত তাদেরকে। এরপর তাদের বাড়ির পাশের টেলিফোন লাইনের খুঁটির নিচে বসিয়ে সারা রাত পাহারা দিতে হত। সারা দিনের কষ্টের পর রাতের আধারে বাতি জালিয়ে রাত পার করতে হত সাধারণ মানুষদের। আর পিস কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা এলাকার সকল খবরা খবর পৌঁছে দিত খান সেনাদের ঘাটিতে।

দেবহাটা অঞ্চলে পিস কমিটির প্রধান ছিল তৎকালিন প্রভাবশালী নেতা আব্দুল করিম মিয়া। তাদের এই অমানসিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখে তার ধমনীতে মুক্তির চেতনা জাগতে থাকে।

পারুলিয়ার সম্মুখ যুদ্ধ:

চলছে স্বাধীনতার যুদ্ধ। ধীরে ধীরে শত্রুমুক্ত হচ্ছে এক একটি এলাকা। বর্ষার সময়। ঝুম ঝুম করে বর্ষা হচ্ছে। সখিপুর-পারুলিয়া বাজারে অবস্থান নিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী। মাত্র কয়েক গজ দূরে মুক্তি বাহিনী। থেমে থেমে চলছে গুলি। সতর্ক অবস্থায় উভয় বাহিনীর সদস্যরা। সেই রাতে পরিকল্পনা হল দক্ষিণ অঞ্চলের একমাত্র চলাচলের ব্রীজটি ধ্বংস করে দিলেই তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু ব্রিজ ওড়ানো এত সহজ ব্যাপার না। কারণ পাক বাহিনীরা ব্রিজের উপরে ডিউটি করছে।

আর তাই পরিকল্পনা করে রাতের আধারে মাথায় কচুরিপানা দিয়ে পানিতে ভেসে ভেসে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণি, তনু গফ্ফার, আব্দুস সুবহান, ইয়াসিন মন্ডল, মোফাজ্জেল হেসেন, অমেদ আলী, ইসমাইল হোসেন, এটিএম জামাত আলীসহ কয়েকজন মিলে শক্তিশালি এক্সপ্লোজি মাইন নিয়ে হাজির হয় ব্রিজের তলায়। সুকৌশলে মাইন স্থাপন করে কিছু দূরে এসেই গুলি করে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানোর মধ্যেদিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর খেজুরবাড়িয়া এলাকায় এন্ট্রি ট্রাংক মাইন ফাটিয়ে গাড়িসহ ১০/১৫ জনকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে পিছু হটতে বাধ্য হয় খান সেনারা।

কুলিয়ার সম্মূখ যুদ্ধ:

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্ত হয় দেবহাটা। ক্যাপটেন শাহজাহান মাস্টার, মেজার জলিল, লেঃ বেগ ও লেঃ মুখার্জির নেতৃত্বে সম্মূখ যুদ্ধ হয় দেবহাটার কুলিয়ায়। ২ দিনের সম্মূখ যুদ্ধে মারা যায় দুই খান সেনা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণি ও হবিবুর রহমান হবি সবার সামনে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। তাদের অনুপ্রেরণায় আমরা মুক্তির নেশায় মরিয়া উঠে জীবন বাজি রেখে সম্মূখ যুদ্ধে করি। যুদ্ধ চলাকালে খানদের একটি সেল গিয়ে লাগে আমার পিছনের যোদ্ধার গায়ে। সামান্যর জন্য আমি বেঁচে গেলেও গুরত্বর আহত হওয়া আমার সহযোদ্ধা সামসুর রহমান পরবর্তীতে মারা যায়।

খান সেনাদের একের পর এক ছোড়া বোমের সিলিং পিছু হাটতে বাধ্য করে মুক্তি বাহিনীর। ওইদিন দুপুরের পর পাকিস্তানি বাহিনী দেবহাটা ছেড়ে খুলনার দিকে রওনা দেয়। আমরাও তাদের পিছু হটাতে তাদের সাথে এগুতে থাকি। একদিন পর আমরা পৌঁছায় খুলনার শিরোমনিতে। সেখানে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় সেনা বাহিনীদের সাথে আমরা মিলিত হয়ে এক সাথে যুদ্ধ করতে থাকি পাকিস্তানি দোষরদের বিরুদ্ধে। এ সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনা সদস্য অনেক জন আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যন্ত শক্তিশালি বুলেটের আঘাতে ছত্রভঙ্গ করে দিতে থাকে মুক্তি বাহিনীদের। বিপর্যয় ঘটতে থাকে মুক্তিকামীদের। এমনই সময় ভারতের বিমান বাহিনী উপর থেকে বোমা মেরে ২টি পাকিস্তানিদের যুদ্ধে ট্রাংক ধ্বংস করে দেয়। আর তাতেই পরাজয় ঘনিয়ে আসতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর।

পরদিন সকালে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে খুলনা মুক্ত হয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বাস্তব গল্প শোনাচ্ছিলেন দেবহাটার মুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী গাজী।

কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি লালন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ দেখতে চান তিনি। আর তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য যুদ্ধকালিন স্মৃতিগুলো তুলে ধরার আহ্বান জানান।

বিজয়ের মাসে দেবহাটার ইছামতির টাকি সীমান্তের বিপরিতে টাউনশ্রীপুরে লেঃ বেগ কর্তৃক ঘোষণাকৃত হানাদারমুক্ত মাটি দেবহাটা ফলটি স্থাপন করতে দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সাবুর আলী।
 

Bootstrap Image Preview