Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ দিবস পালন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ০৬:২৫ PM
আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ০৬:২৫ PM

bdmorning Image Preview


আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ দিবস পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

২৫ নভেম্বর -১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালিত হয়। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে অদ্য ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ইং তারিখ রবিবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সুফিয়া কামাল ভবন মিলনায়তন, ঢাকাতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন, সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানম। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ডিরেক্টর লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি অ্যাড. মাকছুদা আখতার।

উল্লেখ্য এবছর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ “ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে কেন্দ্র, জেলা ও তৃণমূল শাখাসমূহে  ১৫ দিনব্যাপী বহুমূখি কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে আয়শা খানম বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কেন্দ্রসহ সারাদেশে বহুমূখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেন এধরণের নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এবং নারী নির্যাতন নির্মূল হচ্ছে না এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছে, প্রতিরোধের লক্ষ্যে কাজ করছে। নারীরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠা থেকে শুরু করে আইলা মোকাবেলা করছে। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে নানা চ্যালেঞ্জিং পেশায় অংশগ্রহন করছে। পাশাপাশি একটি বিপরীত চিত্রও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্ব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন। ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা কারিকুলাম নারীর প্রতিকূলে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে।

রাষ্ট্র আপোষহীন এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন না করলে সমাজের ভিতরের এই অবক্ষয় রুখে দাড়ানো যাবে না। নারীরা আজ নির্যাতনের রিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। বেসরকারি সংগঠন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করলেও সীমাবদ্ধতা রযেছে। তিনি এক্ষেত্রে মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা কামনা করেন। তিনি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য ও নীতিনির্ধারকদেরও জোরালো ভূমিকা রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, পরিবারের দায়িত্ব নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। এক্ষেত্রে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে, নাগরিক আন্দোলনকে আরো সোচ্চার হতে হবে, গণমাধ্যমকে আরো সজাগ থাকতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ক্ষেত্রে আমরা ১৯২৯ সাল থেকে পিছিয়ে এসেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপ-পরিষদ ২০১৭ সালের ১৪ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার পেপার ক্লিপিং এর তথ্য নিয়ে বাংলাদেশে নারী ও কন্যা নির্যাতন চিত্রের একটি সমীক্ষা করেছে। সমাজকে অগ্রসর করতে হলে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে অ্যাড. মাকছুদা আখতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা, প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়, নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সুপারিশমালা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষকালব্যাপী পনেরো দিনের কর্মসূচি তুলে ধরেন। তিনি নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ১৮ টি সুপারিশ তুলে ধরেন। সুপারিশমালাতে  বলা হয়:

১.       নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার নারীকে দায়ী করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে।

২.       মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে ঘটনাস্থলকে মূখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ ধরনের আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোন বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষনিকভাবে থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে।

৩.      ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে দাড়াতে হবে এবং তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, চিকিৎসাসহ ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে হবে।

৪.       নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়, প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে।

৫.       অপরাধীকে চিহ্নিত করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট এবং আইনের আওতায় আনতে হবে, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

৬.      অভিযোগকারী যেন অনলাইনে তার অভিযোগ নিবন্ধন করতে পারেন, সেজন্য ওয়েবসাইট চালু করতে হবে।

৭.       মাদকের ব্যবসা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

৮.      ধর্ষণের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। প্রচলিত আইন পরিবর্তন করে ধর্ষণকারীকেই ধর্ষণ করে নাই এ বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে মর্মে বিধান প্রণয়ন করতে হবে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার মামলার সাক্ষীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

৯.       উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন নিপীড়ন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাস্তবায়ন ও রায়ের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

১০.     পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন, ২০১২ এর বাস্তবায়ন করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

১১.     ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে দেওয়া মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বাস্তবায়ন করতে হবে।

১২.     পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন,২০১০ সহ নারীর অধিকার সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট সকল আইনের ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

১৩.     তরুণ-যুবসমাজকে নারী ও কন্যার প্রতি সকল প্রকার সহিংসতারোধে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে।

১৪.     নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে বিবেচনা না করে, মানুষ হিসেবে সম্মান করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

১৫.     নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে অধিকতর কার্যকর, দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পৃথক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় করতে হবে।

১৬.     বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর কন্যার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বাতিল করে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।

১৭.     জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।

১৮.    বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে। (বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়সমূহ।)

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে সংরক্ষিত ১৪ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার পেপার ক্লিপিং এর তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে নারী ও কন্যা নির্যাতন চিত্র:২০১৭ (ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা) সমীক্ষা প্রতিবেদন এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের গবেষণা কর্মকর্তা আফরুজা আরমান। তিনি তথ্য সংগ্রহ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি, সমীক্ষা পদ্ধতি, ধর্ষণের শিকার নারী ও কন্যাশিশুর বিষয়ে তথ্য উপাত্ত, ধর্ষকের বিষয়ে তথ্য উপাত্ত , ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরবর্তী প্রভাব, সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা, আইনগত পদক্ষেপ বিষয়ে তথ্য উপাত্ত  উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, সকল বয়স ও পেশার নারী ও কন্যারা নির্যাতনের শিকার হলেও একটি নির্দিষ্ট বয়সের নারী ও কন্যারা যারা পেশায় ছাত্রী এবং বয়স তুলনামূলকভাবে কম তারাই বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কন্যার ক্ষেত্রে ছাত্রীরা অধিক হারে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী বা কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয় পরিচিত মানুষজন বা প্রতিবেশী দ্বারা। কন্যাশিশুদের একটা অংশ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, অপরদিকে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম, যা খুবই উদ্বেগজনক। অভিযুক্তের পেশাগত বিশ্লেষনে দেখা যায়- সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে শিক্ষক দ্বারা এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে তা বেশি।  

সংবাদ সম্মেলনে সহ-সভাপতি নাহার আহমেদ, রেখা চৌধুরী, লক্ষ্মী চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ ও সীমা মোসলেম, সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, অর্থ সম্পাদক দিল আফরোজ বেগম, লিগ্যাল এইড সম্পাদক সাহানা কবির, প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু, আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক বুলা ওসমান, রোকেয়া সদন সম্পাদক নাসরিন মনসুর, প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহানগর শাখার নেতৃবৃন্দ, সংগঠনের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. দীপ্তি সিকদার এবং অ্যাড. রাম লাল রাহা, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ মোট  ৫২ জন উপস্থিত ছিলেন।

 

Bootstrap Image Preview