Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

পরিবেশের সাথে নিষ্ঠুর আচরণে পৃথিবী প্রতিশোধ নিতে ভুলছে না

আবু জাফর সাইফুদ্দিন
প্রকাশিত: ২২ নভেম্বর ২০১৮, ০২:৩৪ PM
আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৮, ০২:৩৪ PM

bdmorning Image Preview


বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা আমাদের সকলেরই জানা। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, মানবসৃষ্ট কার্যকারণে উত্তপ্ত সূর্যরশ্মি (বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর ক্ষয়ে যাওয়ার কারণে) ও গ্রিনহাউস গ্যাস ভূপৃষ্ঠের প্রত্যেক স্থানে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে ডেকে আনছে পরিবেশের বিপর্যয়। পরিবেশের সাথে নিষ্ঠুর আচরণের ফলে পৃথিবী যেন প্রতিশোধ নিতে ভুলছে না।

দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর তীব্র পরিবর্তনে ভূমিকম্প, ঝড়, বন্যা, খরা, টর্নেডো, এসিড বৃষ্টি, ভূমিধস, পাহাড়ধস ও দাবদাহসহ বিভিন্ন রকমের ভয়াবহতা বিশ্বকে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। বৈশ্বিক পরিবেশ-বৈরীতার ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছি না আমরাও।

বিশেষজ্ঞ মহল বলছেন, যে-কোনো ধরনের টেকসই উন্নয়নের প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে পরিবেশের যথোপযুক্ত উন্নয়ন। কেননা পরিবেশ তো জীবনেরই অংশ। কাজেই পরিবেশ সুরক্ষাই হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি।

এ উপলব্ধি থেকে সরকার পরিবেশ সুরক্ষায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীর উপযোগি পরিবেশ নিশ্চিত করতে মোট বনভূমির পরিমাণ সম্প্রসারণ, বন ও বনজ সম্পদের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও শনাক্তকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ দূষণরোধ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং টেকসই পরিবেশ উন্নয়নই হলো গৃহীত কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

কর্মসূচি বাস্তবায়নেও চলছে জোর তৎপরতা। তথ্য-উপাত্তর ভাণ্ডারে দেখা গেছে বেশ কিছু অর্জনও জমা হয়েছে। এরমধ্যে বনভূমি বিস্তারের ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে শতকরা ১৭.৪৮ ভাগ উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ বনভূমির পরিমাণ ২০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে কার্যক্রম।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় সরকারের রয়েছে সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম। যা বাস্তবায়নে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফাণ্ড গঠন করা হয়েছে। ২০১৭-২১৮ অর্থবছর পর্যন্ত এ ট্রাস্টের তহবিলে মোট ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফাণ্ডের আওতায় এ যাবৎ ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় ১১ হাজার ৪১৫ টি ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী গৃহনির্মাণ, ২৩৬.৯৯ কি.মি. রাস্তা নির্মাণ, দেশব্যাপী ৮৭২ কি.মি. খাল খনন অথবা পুনখনন, ৩৫২.১২ কি.মি. বেড়িবাধ, ১৬১.২৩ কি.মি. তীর রক্ষা কাজ এবং ১৬.৪ কি.মি. উপকূল রক্ষা বাধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।

এছাড়া উন্নয়ন সহযোগী এবং দাতাদের সহায়তায় জলবায়ু পরিবর্তন রিজিলায়েন্স ফাণ্ড গঠন করা হয়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকাসহ সারাদেশে ৪,১৮৪টি গভীর নলকূপ, ৫০টি ভ্রাম্যমান পানি শোধনাগার প্লান্ট স্থাপন, ১০৬১টি পানির উৎস, ১০৫০টি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। যা অত্যন্ত সময়োপযোগি।

এদিকে সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টির মাধ্যমে সমুদ্র উপকূল রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং কার্বন নিঃসরণের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসকরণের লক্ষ্যে ১৪৩ মিলিয়ন বৃক্ষরোপণ এবং ৫,১২১ হেক্টর বনভূমি বনায়নের আওতায়ভুক্ত করা, ১২ হাজার ৮১৩টি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন এবং ৯ লাখ ২৮ হাজারটি উন্নত চুলা বিতরণ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ১৭ হাজার ১৪৫টি সোলার হোম সিস্টেম, ২,৪৫১টি পানি বিশুদ্ধকরণ সৌরপ্লান্ট, ১,১৮৮টি সোলার স্ট্রিট লাইট এবং ১৭টি কম্পোস্ট প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইতোমধ্যে ১,৬১৯টি শিল্প কারখানায় ইউটিপি (Effluent Treatment Plant ) স্থাপিত হয়েছে।

ইটভাটার দূষণ থেকে পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর আওতায় দূষণকারী ইটভাটার প্রায় ৬৫.১৭ শতাংশ উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তর করে পরিবেশসম্মতভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ঢাকার পরিবেশ উন্নয়ন ও বুড়িগঙ্গার পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপে আশাবাদী হয়েছে পরিবেশবাদীরা। হাজারীবাগস্থ দূষণকারি ট্যানারি শিল্পসমূহ সাভারের হরিণধারায় চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করায় দীর্ঘদিন ধরে দূষণে আক্রান্ত থাকা নগরবাসী এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। সরকার পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও সংশোধনেরও ব্যবস্থা করেছে। এগুলোর মধ্যে পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ ও বাংলাদেশ জীবনিরাপত্তা বিধিমালা ২০১২ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, ইতিমধ্যে জারি করা হয়েছে। ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি স্ট্রাটেজি এন্ড অ্যাকশন প্লান (এনবিএসএপি) ২০১৬-২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬, জারি করাসহ জাতীয় জীব-নিরাপত্তা কর্মকাঠামো প্রণয়ন করা হয়েছে। বায়োসেফটি পলিসি প্রণয়নের কাজও চলছে।

পরিবেশ দূষণজনিত অপরাধের বিরুদ্ধে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহকে মোবাইলকোর্ট অধ্যাদেশ ২০০৯ এর আওতায় আনা হয়। সরকারের এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণের ফলে পরিবেশ দূষণজনিত অপরাধের বিরুদ্ধে এখন দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আশাবাদী করেছে দেশবাসীকে। জলবায়ু পরির্বতনজনিত ক্ষেত্রে সুদুরপ্রসারী উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের পলিসি লিডারশিপ শ্রেণিতে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ- ২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পরিবেশ সচেতনতার দিক থেকে এই সম্মানটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।

পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের গৃহীত কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন ছাড়াও ভবিষ্যত পরিকল্পনাও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ বনভূমির পরিমাণ ২০ শতাংশে উন্নীত করা। ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের বায়ুর গুণগতমান বাড়ানো এবং বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা। শিল্পকারখানায় বর্জ্য নির্গমন শুণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। ১৫ শতাংশ জলাশয় শুষ্কমৌসুমে অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৬-২০) আওতায় প্রায় ৫০হাজার হেক্টর পাহাড়ি এলাকা: ৫ হাজার হেক্টর সমতল ভূমির বন; ২ হাজার হেক্টর আগর বন; ২০ হাজার কিলোমিটার স্ট্রিপ বন; প্রায় ৫ হাজার হেক্টর শালবন এবং ৩০ হাজার হেক্টর উপকূলীয় বন সৃজন করা হবে।

পরিবেশ উন্নয়ন ও সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগগুলো সুষ্ঠুজ বাস্তবায়নের জন্য সময়োপযোগি কর্মপরিকল্পনা ও রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে এবং এসব সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য মাঠকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবলে পরিণত করতে হবে। এ কাজে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থার পাশাপাশি গণমাধ্যকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
পিআইডি প্রবন্ধ

Bootstrap Image Preview