একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে নতুন সরকার আসছে সেই সরকারকে ১০ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।
এগুলো হল- ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও খেলাপিঋণ রোধ, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ, বৈষম্য কমানো, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, রফতানি বহুমুখীকরণ, সৃজনশীলতা বাড়াতে গবেষণা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা, ভূমির কার্যকর ব্যবহার ও রক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সোমবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) দু’দিনব্যাপী গবেষণা সম্মেলনের সমাপনী দিনে তারা এ কথা বলেন।
রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে সম্মেলনের ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-কি মেসেজ ফর দ্য নেক্সট গভর্নমেন্ট’ শীর্ষক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাহিদি সাত্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এমএ তসলিম, ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গভার্নেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিআইজিএম) পরিচালক ড. মোহাম্মদ তারেক, প্রফেসর ড. স্বপন আদনান।
সভাপতির বক্তব্যে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে অর্থনীতি ও রাজনীতি দুটি পরাশক্তি হিসেবে কাজ করে। তবে সবসময় রাজনীতিই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারকে অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। সেজন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্র আছে। যেমন গত কয়েক সপ্তাহে তড়িঘড়ি করে অসংখ্য প্রকল্প পাস হয়েছে। এগুলোর অর্থায়ন কোথায় থেকে কীভাবে হবে সেটি চিন্তা করা হয়নি। অনেকের নানা চাওয়া-পাওয়ার দিকে দেখে এটি করা হয়েছে।
পরবর্তী সরকার এসে প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন নিয়ে চিন্তা করবে। তাছাড়া নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বৈদেশিক লেনদেনে কিছুটা টানাপোড়েন আছে। ফলে রিজার্ভ কমে গেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর দুর্বলতা বা কারসাজি করছে।
পরবর্তী সরকার নতুন করে মূল্যায়ন করতে পারে। সরকার একদিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুর্নীতি ও অন্যায়কে সুযোগ-সুবিধা করে দিচ্ছে, একই সঙ্গে কল্যাণমুখী ধারণাও বহন করছে। দুটি একসঙ্গে হওয়াটা প্যারাডক্স।
এটি মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি অনিয়ম দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে শিল্পায়ন করতে হবে। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রবৃদ্ধিকে দ্বিতীয় ধাপে নিতে হলে মেধার লালন করতে হবে।
ড. শামসুল আলম বলেন, আগামী মার্চ মাস থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু হবে। সেই সঙ্গে ২০২২ সাল থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরির কাজও শুরু হবে। বাংলাদেশ যাতে মধ্য আয়ের ফাঁদে না পড়ে সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ রয়েছে।
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় শত বছরের ডেল্টা প্ল্যান তৈরি হয়েছে, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, পায়রা বন্দর তৈরি এবং মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুত হচ্ছে। আগামী দিন হবে মেগা প্রকল্পের দিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে কোনো জাদু নেই, আছে পরিকল্পনা, গবেষণা এবং সৃজনশীলতা।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতির মধ্য আয়ের হাইওয়েতে অবস্থান করছে। এখন সে অনুযায়ী জ্বালানি দিতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ যাতে মধ্য আয়ের ফাঁদে না পড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে। আগামী নতুন সরকারের জন্য স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এগুলো হল- বৈদেশিক আর্থিক বাজারে অস্থিরতা, এক্সচেঞ্জ রেটে অস্থিরতা, ফাইন্যান্সিয়াল মার্কে বেশি সুদের হার, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের অধিক মূল্যস্ফীতি, রফতানি বহুমুখীকরণ, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বৈষম্য কমানো, বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ বাস্তবায়ন, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি।
ড. জাহিদি সাত্তারা বলেন, অর্থনীতি বহুমুখীকরণ করার দিকে আগামী সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ প্রযুক্তির প্রয়োগ, শ্রমশক্তিকে বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে হবে।
ড. তারেক বলেন, যখন কোনো একটি দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, তখন এটাকে ছেড়ে দেয়া বা অবহেলা করা উচিত নয়। সরকারের উচিত সেটি নিয়ন্ত্রণ করা। আগামী ১০-১৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে নিয়ে যেতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিআইডিএসের মহাপরিচালক কেএএস মুর্শিদ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
বিনায়ক সেন বলেন, আর্থিক অনেক সূচকে নেতিবাচক অবস্থা দেখা যাচ্ছে। আগামী সরকারকে সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। ড. এমএ তসলিম বলেন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।