বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূণ আহমেদ ও সংগীতশিল্পী-অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের ১৪তম বিবাহ বার্ষিকী ১২ ডিসেম্বর। ২০০৪ সালের এই দিনে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। দিনটি উপলক্ষে স্মৃতিচারণ করছেন স্ত্রী শাওন।
নিজের বিবাহিত জীবনেও কম বিতর্কের শিকার হননি অভিনেত্রী ও সংগীতশিল্পী মেহের আফরোজ শাওন। প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের এ নতুন সিদ্ধান্তে দেশজুড়েও সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে, সে সমালোচনায় কান পাতেন নি হুমায়ূন।
মঙ্গলবার নিজের ১৪তম বিবাহবার্ষিকীতে শাওনের স্মৃতিচারণে উঠে এলো হুমায়ূনের জীবনের কিছু অজানা অধ্যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমায়ুনহীন শাওন লিখেছেন, “অশুভ ১৩… এই ১৩ সংখ্যাটাই আমার জন্য সবচেয়ে শুভ। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির (হুমায়ূন আহমেদ) জন্ম ১৩ তারিখ। আমাদের বিয়ের তারিখও ১৩ হবার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই হুমায়ূন ভাবলেন একদিন আগেই বিয়ে করবেন। ঠিক করলেন ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ১২ তারিখ (১২/১২/১২) ধুমধাম করে উদযাপন করবেন।”
বিয়ে নিয়ে আপত্তি ছিল না হুমায়ূনের মা আয়েশা ফয়েজের। বিয়ের খবর নিয়ে গেলেন তার প্রিয় বান্ধবী হুমায়ূনের নিত্যসহচর প্রকাশক মাজহারুল ইসলামের মা। বিয়ের আসরে উপস্থিত না হলেও বড় ছেলের দ্বিতীয় বিয়েতে অমত করেননি তিনি।
শাওনের লেখায় উঠে এলো সেদিনের কথা- “প্রকাশক মাজহারুল ইসলামের মা (আমার শাশুড়ী মা’র প্রিয় বান্ধবী) যখন তাঁর কাছে বিয়ের খবর জানিয়ে আমাদের জন্য দোয়া চাইতে গেলেন, তখন তিনি স্পষ্টভাবে বললেন তাঁর বড়পুত্রের বুদ্ধি এবং দূরদর্শিতার প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা আছে। বড়পুত্র যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন নিশ্চয়ই নিজের ভালো বুঝেশুনেই নিয়েছে। নিজে উপস্থিত না হলেও প্রিয়পুত্রের সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁর শুভকামনা সবসময়ই থাকবে।”
শাওন লিখেছেন, “খুব সাদামাটা ভাবেই হওয়ার কথা ছিল আমার বিয়েটা। ভেবেছিলাম কোনোরকম একটা শাড়ি পরে তিনবার কবুল বলা আর একটা নীল রঙের কাগজে কয়েকটা সাইন। আমার পরিবারের কেউ আমার সাথে নেই। এমনকি নেই কোনও বন্ধুও। সবাই ত্যাগ করেছে আমাকে।”
কিন্তু সাদামাটা বিয়ে কি আর ম্যাজিশিয়ান হুমায়ূনের হতে পারে? সেদিনের ব্যাপারে শাওনের লিখেছেন, “ডিসেম্বরের ১১ তারিখ হুমায়ূন আমাকে জোর করে পাঠালেন নিউমার্কেটে। উদ্দেশ্য একখানা হলুদ শাড়ি কিনে আনা, যেন সন্ধ্যায় আমি হলুদ শাড়ি পরে নিজের গায়ে একটু হলুদ মাখি।
তার ভাষ্য, হুমায়ুন বললেন- ‘তোমার নিশ্চয়ই বিয়ে নিয়ে, গায়ে হলুদ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। আমাকে বিয়ে করার কারণে কোনোটাই পূরণ হচ্ছে না। আমি খুবই লজ্জিত। তারপরও আমি চাই আজ সন্ধ্যায় তুমি হলুদ শাড়ি পরে ফুল দিয়ে সাজবে। নিজের জন্য, তোমার ভবিষ্যত সন্তানের জন্য, আমার জন্য, আমরা দু’জনে মিলে আজ গায়ে হলুদ করবো।”
একা একাই শাড়ি, গাঁদা ফুলের মালা, আর হুমায়ূনের জন্য লাল পাঞ্জাবী কিনলেন শাওন। সন্ধ্যায় সাজেনও একাই।
শাওন লিখেছেন, 'বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে আমার চোখ ফেটে পানি চলে আসলো, চোখ মুছে খোঁপায় কানে গাঁদাফুলের মালা গুঁজলাম, হঠাৎ শুনি বাথরুমের দরজায় ধুমধাম শব্দ। দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি ডালা কুলো হাতে মাজহার ভাইয়ের স্ত্রী স্বর্ণা ভাবী, পাশে ৩ বছরের ছোট্ট অমিয়। একটু দূরে লাল পাঞ্জাবী পরা হুমায়ূন ঠোঁট টিপে হাসছেন। হই হই করে ঘরে ঢুকলো হুমায়ূনের আরো বন্ধু আর তাদের স্ত্রীরা। তারা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল পাশের রুমে।'
চার-পাঁচটা প্রদীপ দিয়ে সাজানো এক পাশে ছিমছাম আয়োজনে গায়ে হলুদ উদযাপন করলেন তারা। গায়ে হলুদে উপস্থিত হয়েছিলেন লেখক মইনুল আহসান সাবের ও তার স্ত্রী কেয়া, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ও তার স্ত্রী স্বর্ণা। শাওনের হাতে রাখি পরিয়ে দিলেন তারা, হুমায়ূনের গালেও তাদের খুনসুটিতে কাঁচা হলুদ লেগে গেছে।
শাওনকে কুসুম বলে ডাকতেন হুমায়ূন। নিজেকে কুসুম বলেই স্মৃতিচারণায় লিখলেন শাওন, 'আজ ১২ ডিসেম্বর, ২০০৪-এর এই দিনে কুসুম আর হুমায়ূন নতুন জীবন শুরু করেছিল। কুসুম তার জীবনের সবচাইতে শুভ ১৩ বছর পার করে ফেলল। কুসুমকে শুভেচ্ছা। কুসুমের হুমায়ূনকে শুভেচ্ছা।'
২০০৩ সালে প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় হুমায়ূনের, প্রথম পরিবারে তিন কন্যা ও এক সন্তানের থেকে দূরে সরে গিয়ে, ২০০৪ শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মারা যান হুমায়ূন আহমেদ। বর্তমানে তার দুই সন্তান নিষাদ-নিনিতকে নিয়ে হুমায়ূনের ধানমন্ডির আবাস ‘দখিন হাওয়া’য় বসবাস করছেন শাওন।