Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

সত্তরের সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ

এম. শরীফ হোসাইন, ভোলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০১৮, ০২:৪৯ PM
আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৮, ০২:৪৯ PM

bdmorning Image Preview
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান


ঐতিহাসিক ১২ নভেম্বর আজ। ১৯৭০ সালের এই দিনে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চলসহ ভোলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিলো। সেই স্মৃতি আজো যারা বেঁচে রয়েছেন এবং তাদের মধ্যে যারা আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছেন সেই বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়তেই আতঙ্কে উঠছেন।

দিনটি স্মরণে দেশব্যাপী আলোচনাসভা, সেমিনার, কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিল আয়োজন করে বিশেষ দোয়া মোনাজাত করা হবে। উপমহাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ৭০ সালের ঘূর্ণিজড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছিল। ধরণা হচ্ছে প্রলয়ংকরী ওই দুর্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তন্মধ্যে ভোলা জেলায় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আর অসংখ্য জনপদ বিরান হয়। উত্তাল  মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরিত হয়েছিল লাশের নদীতে। সেকি ভয়াবহ দৃশ্য।
    
১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর বুধবার থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আবহাওয়া আরো খারাপ হতে লাগল এবং মধ্যরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে লাগল সমুদ্র। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসল পাহাড় সমান উঁচু ঢেউ। ৩০/৪০ ফুট উচু সেই ঢেউ আছড়ে পড়ল মানুষের উপর। আর মুহুর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে গেলো মানুষ, গবাদিপশু, বাড়ীঘর এবং ক্ষেতের সোনালী ফসল। পথে প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে পড়েছিলো কেবল লাশ আর লাশ। কত কুকুর, শিয়াল আর শকুন খেয়েছে সে লাশ তার কোন ইয়ত্তা নেই।

সত্তরের সেই কালো রাতের কথা মনে হলে ধুসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসে হয়ে আসে বলে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে। জন-মানুষ শুন্য হয়ে পড়েছিলো দ্বীপজেলা ভোলা।

সেই সময়কার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলার সমস্ত জনপদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল আর নদীতে গবাদি পশুসহ বনি আদম সন্তান সারিবদ্ধভাবে পড়েছিলো। এসব সংবাদ তৎকালীন “পূর্বদেশ” পত্রিকার ভোলাস্থ প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন “বাংলার মানুষ কাদোঃ ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ” শিরোনামে ছাপা হয়েছিলো। আর এ সংবাদ বিশ্বব্যাপী ৪দিন পর জানতে পেরেছিলো। সেই চিত্রটি আজো ঢাকা প্রেস ইনষ্টিটিউট-এ কালের স্বাক্ষী হিসেবে বাধানো অবস্থায় প্রদর্শিত হচ্ছে।

তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও সংবাদকর্মী এম এ তাহের বলেন, ভয়াল সে রাত কেটে গেলে পরদিন শুক্রবার শহরময় ধ্বংসস্তুপ দেখা যায়। প্রায় এক কোমর পানি ছিলো সর্বত্র। চারিধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। পানি ভেঙ্গে তিনিসহ বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মরহুম মোশারেফ হোসেন শাহাজানসহ আরো অনেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করেন। সেদিন সবাই মিলে প্রায় সাড়ে ৩’শ লাশ দাফন করান। তিনি আরো বলেন, পরদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে এক জাহাজ ত্রাণ নিয়ে আসেন ভোলায়। সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মনপুরায়। তাই জাতির পিতা মনপুরায় এসে সকলের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন।
    
স্বজন হারানো পরিবারের একজন ভোলা প্রেস ক্লাবের সদস্য জহিরুল ইসলাম মঞ্জু কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, আমার মাসহ পরিবারের লোকজনকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জলোচ্ছ্বাসে, আমি বেঁচে থেকে প্রতিবছর এই দিনে এলেই সেই শোকে দিশে হারা হয়ে পড়ি। স্বজন হারা আরেক পরিবারের সদস্য ও আর কে ট্রেডিং এর ব্যবসায়ী লক্ষণ বণিক জানান, আমার দাদা বাড়ি তজুমুদ্দিনের গুড়িন্দা বাজার ছিল। ঝড়ের আগে রাতে শো শো শব্দ আর ভয়ে আমার মা আবা রানী বণিক ভোলায় মামার বাড়ী চলে আসেন। ঝড়ও জলোচ্ছ্বাসের পর আমার মা দাদা বাড়ি গিয়ে দেখেন দাদা নকুল বণিকসহ পরিবারের পরিপরিজনরা ভেসে গিয়েছেন। সেই স্মৃতি মনে পড়লে মা আজও কেমন যেন হয়ে পরেন।

দৌলতখান পৌর এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান ৭০’র বন্যার স্মৃতি চারন করতে গিয়ে বলেন, সে দিন ছিল মেঘাচ্ছন্ন। গুরি গুরি বৃস্টি হচ্ছিল। রাতের বেলা দোকান বন্ধ করে ঘরে এসে ঘুমাতে যাই। এমন সময় দোকানের কর্মচারীরা নীচে ঘুমাইতেছিল। তারা অনুভব করে বিছানা ভিজতে শুরু করেছে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে প্রবল বেগে পানি আসতে দেখে তারা তাড়াতাড়ি বাড়ীতে এসে খবর দেয় যে, পানি আসছে। তখন পরিবারের সকল সদস্যদেরকে নিয়ে ঘরের দ্বোতলায় অবস্থান নেই। পরে যখন পানি কমে যায় তখন চারদিকে শুধু পানি দেখতে পাই, কোন ঘর-বাড়ির চিহ্ন নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, তাদের একজন নিকটতম আত্মীয়ের কথা স্মরণ হলে তখন ওই আত্মীয়কে দেখতে যান পানির মধ্য দিয়ে সাতড়িয়েই। যেয়ে দেখেন যে তাদের বাড়ীর কোন চিহ্ন নেই।

তৎকালীন সময়ে দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া গ্রাম এবং বর্তমানে ভোলা সদরের আলীনগর ইউনিয়নের সাচিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আলমগীর মিঝি ৭০’র বন্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ওই বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। বাড়ী একটু দুরে থাকায় তিনি দৌলতখান বাজারের একটি দোকান ঘরের মধ্যে থেকে পড়া-লেখা করছিলেন। রাতের বেলা দেখেন প্রবল বেগে পানি আসছে। সেই সাথে গুরি গুরি বৃষ্টি হচ্ছিল। এসময় তিনি একাকী কি করবেন ভেবে আশ-পাশের দোকানগুলোতে কোন মানুষের অবস্থান আছে কিনা তা বুঝতে চেষ্টা করলেন। তার পাশের একটি দোকানের মধ্যে লোকজনের কথা শুনতে পেয়ে সেখানে যেতে মনস্থ করলেন। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে পানির চাপ প্রচন্ড। এর মধ্যে অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। উপায়ন্তুর না দেখে তিনি ওই পানির মধ্যে ঝাপ দিয়ে পাশের দোকানের বেড়াটি ধরলেন। পরে তিনি দোকানের উপরে থাকা লোকজনকে ডাক দিলে তারা তাকে উপরে তোলেন। সকাল বেলা তিনি বাড়ীতে গিয়ে দেখেন যে, ঘরগুলো বন্যায় ভেঙ্গে দুমরে-মুচরে গেছে। যাওয়ার সময় তিনি পথে পথে হাজারো লোকের মরদেহ পরে থাকতে দেখেছেন। এমনকি বিভিন্ন গাছের সাথে মরদেহগুলো ঝুলতে দেখেছেন। ওই বন্যার সময় তাদের ঘরে লোকজন ছিলনা। তাই বড় ধরনে কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি। তবে তাদের বাড়ী থেকে প্রায় ৩৯ জনের মত লোক ওই বন্যায় প্রাণ হারায়।  

১৯৭০ এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে পর ভোলার বিভিন্ন অঞ্চলে লাশের সৎকার ও বেঁচে থাকা মানুষদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রিলিফ বিতরণ করতে গিয়ে যে দৃশ্য পেয়েছি তা বর্ণনা করতে গিয়ে ভোলা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফজলুলকাদের মজনু মোল্লা, ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ মোফাজ্জল হোসেন শাহীন, জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম নিরব মোল্লা স্মৃতি চারণ করে বলেন, যারা সে সময় বেঁচে ছিলেন তাদের পাশে যখন গিয়েছি তখন কি করব ভেবে পাইনি।

জননেতা মাওলানা ভাষানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানসহ যারা এদৃশ্য দেখতে আসেছেন আবেগ আপ্লুত হয়ে পরেন এবং তারা বলেন, সেই সময়ের শাসক (ইয়াহিয়া খান’রা) বাংলার স্বজন হারাদের পাশে এগিয়ে আসেন নি এবং তাদের খোজ পর্যন্ত নেন নি। তখন সারা বিশ্বব্যাপী তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্টিকে ধিক্কার দিয়েছিল। এখনো স্বজন হারা পরিবার গুলো যেভাবে আছে তাদের পাশে সকলেই দাড়ানো উচিত বলে তারা অভিহিত করেন। এই দিনটিতে প্রেসক্লাবসহ সামাজিক সংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আলোচনা সভা, স্মরণ সভা, দোয়া ও কোরআন খানী ব্যবস্থা করে থাকেন। কিন্তু ভোলাবাসীর প্রাণের দাবি এ দিনটিকে একটি জাতিয় শোক দিবস হিসাবে ঘোষণা করে সরকারী ও বেসরকারি পালন করার হউক। পাশা-পাশি এ উপকূলীয় অঞ্চলে এখনো পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র ও মাটির ট্রিলা নির্মাণ করা প্রয়োজন এবং জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটসহ সকল প্রশাসন তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

Bootstrap Image Preview