Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

বাজারে উৎপাদন খরচের '১৩ গুন' বেশি দামে নতুন আলু

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ০২:৩৪ PM
আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ০২:৩৭ PM

bdmorning Image Preview


শীতের দিনে সবজির প্রতি মানুষের অন্যরকম আকর্ষন থাকে। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ফায়দা লুটতে চায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। বাজারে অনেক আগে থেকেই আসতে শুরু করেছিল শীতে আগাম সবজি। তবে এখন বাজারে আসতে শুরু করেছে শীতের অন্যতম সুস্বাদু সবজি নতুন আলু। উৎপাদন খরচ কম হলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা কারসাজিতে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা ও কৃষকরা।

প্রতি বছর এ সময় আলুকেন্দ্রিক ব্যবসায় গড়ে উঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের কারণে প্রতি বছর ঠকে যাচ্ছে কৃষক ও ভোক্তারা। তবে লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।

দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভালো থাকার পরও উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে নতুন আলু। এছাড়া যে আলু ভোক্তা পর্যায়ে কেজিতে মানভেদে ১২০-১৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে, সে আলু কৃষক বিক্রি করছেন মাত্র ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। এতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ে ঠকলেও লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, একর প্রতি জমি তৈরিতে কৃষকের খরচ হয় ৪ হাজার ৪৩৪ টাকা। সার বাবদ ১১ হাজার ৫৪২ টাকা।

বীজ বাবদ ১৪ হাজার ২৬ টাকা। শ্রমিক নিতে খরচ হয় ২০ হাজার ২৭৮ টাকা। সেচ খরচ ৪ হাজার ১৮৪ টাকা। কীটনাশকে খরচ হয় ৫ হাজার ৩৬১ টাকা। জমি লিজ বা ভাড়া ১৪ হাজার ১৮৮ টাকা ও অন্যান্য খরচ ৫ হাজার ৯৬৬ টাকা। তাহলে একর প্রতি উৎপাদন খরচ হয় ৭৯ হাজার ৯৩৪ টাকা। সে ক্ষেত্রে একর প্রতি মোট উৎপাদনের পরিমাণ ১০ হাজার ৫১৯ কেজি আলু। আর কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ হয় ৭ টাকা ৬০ পয়সা।

ওই জরিপে আরও বলা হয়, মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে এক কেজি আলু ফড়িয়া ও স্থানীয় ব্যবসায়ী চক্রের কাছে কৃষকের বিক্রির যৌক্তিক মূল্য প্রতি কেজি ৮ টাকা ৮৫ পয়সায়। কৃষক থেকে বড় পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে বিক্রির যৌক্তিক মূল্য ১২ টাকা ২০ পয়সায়।

পাইকারি বিক্রেতার পর এ আলু খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রির যৌক্তিক মূল্য ১৭ টাকা ১৫ পয়সায়। আর জরিপ অনুযায়ী ভোক্তার কাছে খুচরা বিক্রেতাদের এ আলু যৌক্তিক বিক্রয় মূল্য হল ২২ টাকা। কিন্তু ভোক্তারা এ আলু মৌসুমের শুরুতে কিনছেন প্রতি কেজি ১২০-১৩০ টাকায়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি বিপণন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের সব সময় চেষ্টা থাকে কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্য পায়। তবে দেশে কিছু বাস্তবতা আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হল দেশের কৃষকরা আলু মাঠ থেকে উঠিয়ে বেশির ভাগ সময় ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে। যার কারণে তারা দাম পাচ্ছে না।

জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কৃষকরা কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করে কখনও ভালো লাভের মুখ দেখতে পান না। ফড়িয়াদের কারণে তাদের ফসল উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়।

কিন্তু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ভোক্তাদের এ পণ্য উচ্চমূল্য দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এতে কৃষক ও ভোক্তা সব সময় প্রতারিত হন। শুধু লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগীরা।

তিনি আরও বলেন, যদি কৃষক থেকে সরাসরি পণ্য বাজারে আনার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের এ তৎপরতায় কখনই লাগাম দেয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া কৃষক থেকে ফড়িয়া ও ভোক্তাপর্যায়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এতে কৃষক ও ভোক্তা উপকৃত হবেন। তাহলে কৃষকও তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন। আর ভোক্তারাও কম মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, অনুকূল আবহাওয়া ও রাসায়নিক সার পর্যাপ্ত থাকায় প্রতি বছর আলু উৎপাদন বাড়ছে। অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৯৪ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩০ লাখ ৪ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়।

অধিদফতর সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশ থেকে আলু রফতানি হয় ২৭ হাজার ৫৭৮ মেট্রিক টন। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ২ হাজার ৯৮৩ টন। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ কমে যায়।

এ সময় ৯৪ হাজার ৬১৩ টন রফতানি হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হয় ৪০ হাজার ২২৯ টন। তবে অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি হয় ৫৫ হাজার ৬৫২ টন।

জানা গেছে, দেশ বছরে আলুর চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। আর দেশে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন প্রায় ৮৪ লাখ টন। আর বাড়তি উৎপাদনের কারণে আলুর দাম ব্যাপক কমে যাওয়ায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হয়।

কিন্তু দেশে এত আলুর জোগান থাকার পরও মৌসুম এলেই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী নতুন আলু উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। এতে কৃষকেরও কোনো উপকার হয় না। আর ভোক্তারাও ঠকে যাচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলু বিক্রেতা মো. জসিম বলেন, মোকাম থেকে আমরা সরাসরি আলু কিনতে পারি না। সেখান থেকে কয়েক হাত ঘুরে আমাদের কাছে আসে।

আমরা বেশি দামে কিনে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করি। তবে দাম বাড়ার পেছনে মোকাম থেকে আমাদের হাত পর্যন্ত আসতে মধ্যস্বত্বভোগীরা শুধু শুধু বেশি মুনাফা করে। যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তাপর্যায়ে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক (উপসচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমরা এর মধ্যে অধিদফতরের পক্ষ থেকে একাধিক মনিটরিং টিমকে কাজে লাগিয়েছি। তারা প্রতিদিন বাজার তদারকি করছে।

তবে এবার কৃষকের মাঠ থেকে বাজার পর্যন্ত মনিটরিং করা হবে। যাতে মৌসুমে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তার চাহিদাকে পুঁজি করে অতি মুনাফা করতে না পারে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা কেন্দ্রের (ইফপ্রি) এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়, গত পাঁচ যুগে বাংলাদেশে নীরব আলুবিপ্লব ঘটে গেছে। ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য ও খাদ্যশক্তির উৎস হচ্ছে আলু। গত পাঁচ যুগে এর উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। আর মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। দেশের খাদ্যশক্তির এখন দ্বিতীয় প্রধান উৎস হচ্ছে আলু।

অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০১৩ সালের সর্বশেষ আলুর উৎপাদনবিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি।

Bootstrap Image Preview