Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

খালেদা-তারেক 'বাদ'; কার হাতে যাবে বিএনপির নেতৃত্ব?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ নভেম্বর ২০১৮, ০১:০৬ PM
আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮, ০১:২৫ PM

bdmorning Image Preview


কঠিন দুঃসময়ে বিএনপি। একদিকে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব অন্যদিকে সিনিয়র নেতাদের হতাশা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একের পর এক মামলা। এমন অগোছালো বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করলেও একাদশ নির্বাচনে অংশ নিয়ে হাত মিলিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কামাল গংদের সাথে। এ অবস্থায় বিএনপিতে নতুন করে দেখা দিয়েছে নেতৃত্ব সংকট।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণার ১০ দিন আগে ৭ নম্বর ধারা বাদ দিয়ে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেয় বিএনপি। বিএনপির গঠনতন্ত্রে দলের নির্বাহী কমিটির পদে থাকা ও দল থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়া সংক্রান্ত ৭ নং ধারা সংশোধন করা হয়। এই ৭ নং ধারা নিয়ে সংশোধিত অংশ গ্রহণ না করতে ৩০ অক্টোবর বুধবার ইসিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্ট বলেছে, বিএনপির গঠনতন্ত্রের যে ৭ ধারা বিলোপ করেছিল, সেটি গ্রহণ না করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দণ্ডিত ব্যক্তিদের দলীয় কমিটিতে না রাখার যে বিধান বিএনপির গঠনতন্ত্রে ছিল, সংশোধনীতে তা বাদ দেওয়া কেন বেআইনি হবে না এবং সংবিধানের পরিপন্থী হবে না, তা-ও জানতে চেয়েছেন আদালত। হাইকোর্টের রায়ের পর রায়ের সার্টিফাইড কপি নির্বাচন কমিশনের কাছে যাবে। গঠনতন্ত্রে যে সংশোধন এনেছিল বিএনপি, নির্বাচন কমিশন সেটি বাতিল করে দেবে। হাইকোর্টের আদেশ পালন করা তাদের বাধ্যতামূলক।

সব মিলিয়ে কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে বিএনপি। এ অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্ব যাবে কার হাতে? যদিও জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ৫ বছর কারাদণ্ডের পর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে তারেক রহমানের না ঘোষণা দিয়েছিলেন।

মির্জা ফখরুল তখন বলেন, আমাদের গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে দল কীভাবে চলবে, এ নিয়ে মাথা ব্যথার কোনো কারণ নেই। দল তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৫(গ) ধারায় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটির সভা ডাকাসহ চেয়ারপারসনের অন্য সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনায় এই দুজন ছাড়া অন্যদের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কেননা এ দুজনের বাইরে কেউই দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক ডাকতে পারেন না। আর এ বৈঠক না হলে কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন পায় না।

এছাড়া বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, চেয়ারম্যানের সাময়িক অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান।

উল্লেখ্য, বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীপদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ তাঁরা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।

এ রকম পরিস্থিতিতে বিএনপির মধ্যেও চিন্তা-ভাবনা চলছে, যদিও হাইকোর্টের এই আদেশ কার্যকর হয়, সেক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বের কি হবে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা অনেক আগে থেকেই বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সবাই অপেক্ষায় থাকে লন্ডনের ফোনের। সমন্বয়হীনতা ও ব্যাপক মতানৈক্যতার কারণে রাজপথের অন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে সিনিয়র নেতারা। দেশের সব কিছুতেই বিএনপি এখন মির্জা ফখরুলে উপর নির্ভরশীল। আবার স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদ- দলের মধ্যে যথোপযুক্ত 'কর্তৃত্ব' নেই। কারণ আন্দোলনের সময় সারাদেশের জেলা, উপজেলা, পৌরসভা পর্যায়ে বিএনপির কর্মীরা রাজপথ দখলে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় রাজপথে নামার ক্ষেত্রে দলের ব্যর্থতার চিত্র কর্মীদের চাঙ্গা করার চেয়ে হতাশ করেছে বেশি। জেলার মাঠ পর্যায়ের সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে কেন্দ্রের সাধারণ কর্মীরাও ঢাকার অনেক নেতার ভূমিকা নিয়েই সন্ধিহান। কয়েকজন সাধারণ কর্মীর সঙ্গে কথা বলে এমন মনোভাব জানা গেছে। তাঁরা আন্দোলনের মাঝে অনেক নেতার গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনাকেও সন্দেহের চোখে দেখেন। আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহুর্তে ঝুঁকি না নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকতেই কয়েকজন নেতা ধরা দিয়েছেন বলেও সন্দেহ আছে দলটির মাঠের কর্মীদের মধ্যে।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বিএনপি এবার নির্বাচন হাতছাড়া করতে চায় না। নির্বাচনের ব্যাপারে জেলে থাকা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। নির্বাচন ঘিরে এখনই দলের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বৃহত্তর জোট নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে।

তবে নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা দূর করতে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান আসতে পারেন সামনের সারিতে। যদিও আগে তারেক জিয়ার স্ত্রী জোবায়দা রহমানের নাম এসেছিল। কিন্তু তিনি  ইংল্যান্ডে তাঁর পাসপোর্ট স্যারেন্ডার করেছেন। যে কারণে তাঁর এখন বাংলাদেশে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এদিকে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিএনপি ‘উজ্জীবিত’। তাই তার নামটাও সামনের সারিতে। তার সংলাপের চিঠিতেই সায় দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যদিও সংলাপ বিষয়ে চিঠি চালাচালি ও বিভিন্ন কথার মধ্যেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ হয়। আগে ওই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড উভয়ই হয়েছিল।

এদিকে বিএনপি নেতা জয়নুল আবেদীন বলছেন, মোজাম্মেল হোসেন নামের যে ব্যক্তি বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধনের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেছেন, তাঁর এই রিট পিটিশন করার কোনো এখতিয়ার নেই। একটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র এখানে রিট পিটিশন মেইন্টেনেবল না। এখানে বিএনপির লোকজনকে পক্ষ করা হয়নি, বিএনপির অথরিটিকে পক্ষ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা আদেশের কপি সংগ্রহ করছি, যদি দেখি যে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সে ক্ষেত্রে সেটাই নেব। অনেক সময় আদালতকে ভুল বুঝিয়ে অর্ডার নিয়ে নেওয়া হয়। এটা নিয়ে আমরা বসব, সিনিয়র আইনজীবীরা বসবেন, তারপর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

‘দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, জনসমর্থিত ও গণমানুষের একটি দল বিএনপি। মানুষের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন হয়েছেন, তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন। এখানে কারও নাক গলানোর অধিকার আছে বলে আমরা মনে করি না। কে কী বলল, তাতে আমাদের কিছু আসে–যায় না।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া আমাদের দলের চেয়ারপারসন, বর্তমানে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান—এই বিশ্বাস নিয়ে দেশের মানুষ সংগ্রাম করে যাবে।' এমনটাই আশা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।

বিএনপি, গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টের নেতারা বলছেন, এখন আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ঐক্য হচ্ছে। আগামী দিনে এটা নির্বাচনী জোটেও রূপ নিতে পারে। তখন একজন নেতাকে সামনে রাখতে হবে। যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম মিলে যে জোট হয়েছে, তাতে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রাখার ব্যাপারে জোট অনেকটাই একমত। অন্যদিকে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানকে রাখা সম্ভব না হলে অন্তত জিয়া পরিবারের কাউকে অথবা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সামনে আনার পক্ষে। জিয়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে এগিয়ে রাখার পক্ষে। কেউ কেউ ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথির কথাও বলছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির জন্য তাঁরা এখন আন্দোলন করবেন। দাবি আদায়টাই এখন মুখ্য। তবে নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছে বলেও তিনি জানান। নির্বাচনী জোট ও নেতৃত্ব নিয়ে তিনি বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করার জন্য সবাই কাজ করবেন। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত হবে এই জোট একসঙ্গে নির্বাচন করবে কি না। কার নেতৃত্বে নির্বাচন হবে, তা তখনই ঠিক করা হবে।

যদিও বিএনপির সূত্রটি জানায়, নির্বাচনী জোটে কে নেতৃত্ব দেবেন এবং সরকার গঠন করলে তার প্রধান কারা হবেন, এসব বিষয় খালেদা জিয়াই নির্ধারণ করবেন। নেতৃত্বে থাকতে পারেন জাতীয় ঐক্য থেকে সমাজে গ্রহণযোগ্য কেউ, দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিসম্পন্ন এবং খালেদার পরিবারের কেউ।

Bootstrap Image Preview