১৯৭১ সালে জীবনকে বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধে যোগ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ ব্যাপারী। লড়াই-সংগ্রামে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েও পিছু হটেননি তিনি। ধৈর্য ও সাহসিকতা দিয়ে শক্র সেনাদের বিপক্ষে যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৪৮বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পাননি। জীবনের শেষ বেলাতে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতিটুকু চান ৭১’এর যোদ্ধা মোঃ আব্দুস সামাদ ব্যাপারী।
মাত্র দু’বছর আগে বিয়ে করেছেন, স্ত্রীর কোলে ৩-৪ মাস বয়সের পুত্র সন্তান আঃ হক। চিলমারী উপজেলাধীন চিলমারী ইউনিয়নের চর বৈইলমনদিয়ার খাতা গ্রামের মৃত ফজল ব্যাপারী ও মৃত বয়জন নেছার ছেলে আব্দুস সামাদ ব্যাপারী তখন ২০-২৫বছরের যুবক। লেখা-পড়া করেনি তাই সারাদিন নৌকা বেয়ে মানুষ পারাপার করে আয় রোজগার করতেন তিনি।
১৯৭১ সাল, সারাদেশে শুরু হয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন আর বাংলার মাটিকে দখলের যুদ্ধ। মা-বোনদের বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাষবিক অত্যাচার চালাতো পাকিস্তানী নরপিশাচরা। চার দিক থেকে ভেসে আসছে শুধু গোলাগুলির শব্দ। হঠাৎ একদিন পাক সেনারা বৈইলমনদিয়ারখাতা গ্রামে আক্রমন চালায়। বাড়ী ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং পাষবিক নির্যাতনের তান্ডব চালাতে থাকে। তাদের তান্ডবে ৩মহিলাসহ ৪জন গুলিবিদ্ধ হয় এবং তাৎক্ষণিক জহিরন নেছা নামের এক মহিলা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পাকিস্থানী হায়ানাদের
এমন তান্ডব দেখে আব্দুস সামাদ আর নিজেকে সংবরন করতে পারেননি।এমনিতেই আগে থেকে সার্বক্ষনিক তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পারাপারসহ বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করে আসছিলেন।
এবারে বাড়ী থেকে নিজ ইচ্ছায় বের হয়ে যান দেশ মাতৃকার সম্ভ্রম রক্ষার্থে তিনি। মুক্তি যোদ্ধা হয়ে নিজের মাতৃভুমিকে স্বাধীন করার ইচ্ছা লালন করে নদী পাড় হয়ে রৌমারীতে দেশ মাতৃকা রক্ষার যুদ্ধে যোগদান করেন আব্দুস সামাদ। সেখান থেকে পায়ে হেটে প্রশিক্ষণ নেয়ার উদ্দেশ্যে মানকারচর ও কামাখ্যায় যান এবং ৩দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে যুদ্ধে লিপ্ত হন তিনি।পরবর্তীতে আব্দুস সামাদ চিলমারী, বালাশি, কামারজানি, কালাসোনা, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন যায়গায় প্রতক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। শত্রুদের দমনের জন্য হ্যান্ড গ্রেনেড(বোমা) মারতে গিয়ে তার মুখের দুটি দাত পরে গিয়েছিল বলে জানান তিনি। সহযোদ্ধা হিসেবে প্রয়াত আলম চেয়ারম্যান, রাঙা, তাহমিদুর রহমান চাদ, ইছাহক আলীদের নাম বলেন তিনি।
নিরক্ষর আব্দুস সামাদ দেশ স্বাধীনের পর জীবিকার তাগিদে নৌকা বেয়ে মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত থাকায় কোন সনদ কিংবা গেজেটের সন্ধান করেননি। তাই তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্তে¡ও সকল প্রকার সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে ১২বার নিজ বাড়ী-ভিটা নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বর্তমানে তিনি রমনা ব্যাপারীপাড়া এলাকায় অবস্থান করছেন।
আব্দুস সামাদ ব্যাপারী জানান, ১৯৭১ ইং সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১নং সেক্টরে মুক্তি যোদ্ধাদের নৌকা পাড়াপার করা এবং বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন তিনি। তিনি আরও জানান, প্রায় ৬বছর থেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় তিনি ছেলেদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তার ৪ ছেলে নদীতে মাছ ধরে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করে।
কান্না জড়িত কন্ঠে আব্দুস সামাদ বলেন, নিজের জীবন নিয়ে না ভেবে দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধ করেছি, রাষ্ট্রীয়ভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেলে আমার সন্তানরা এই দেশের মাটিতে মাথা উচুঁ করে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে পারত আর আমি মরেও শান্তি পেতাম।