Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

কেরানীগঞ্জের আগুনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৩

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৪৯ AM
আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৪৯ AM

bdmorning Image Preview
কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত স্বামীর মৃতদেহের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে অপেক্ষারত আলমের স্ত্রী


ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৩ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্য একজন ঘটনাস্থলে আর ১২ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, দগ্ধ লোকজনের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। তাদের অধিকাংশের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে।

গত বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ লোকজনের মৃত্যু ঘটে।

এদিকে গতকাল সকালে শ্রম সচিব কে এম আলী আজম ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিত্সাধীন শ্রমিকদের দেখতে গিয়ে বলেন, ‘এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। এ কারখানাটি কমপ্লাইন্স নয়। এর আগে মালিককে একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং শ্রম আইনে মামলাও করা হয়েছে। তারপরও কীভাবে চলছিল কারখানাটি তা অনুসন্ধান করে দায়ীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আগের দিন সন্ধ্যায় দগ্ধ লোকজনকে দেখতে হাসপাতালে যান বিদ্যুত্ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এবং কেরানীগঞ্জের সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপু। এ সময় তিনি অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে উল্লেখ করে বলেন, কারখানাটির কোনো অনুমোদন ছিল না বলে জানা গেছে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে থাকা কারখানাগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলেছিলেন। তবুও তাদের সরানো যায়নি।

এর আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৭০ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টাম্পাকো প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে আগুনে নিহত হন ২৪ জন। এর আগে নিমতলীতে মারা যান ১২৪ জন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কেউ শঙ্কামুক্ত নয় :

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১২ জনের মৃত্যুর পর অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আট জন ভর্তি রয়েছেন। এছাড়া শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন ১০ জন। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক সামন্তলাল সেন বলেন, কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি কারো অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়। সবার শ্বাসনালি পোড়া। চাকরিজীবনে এমন ভয়াবহ পোড়া রোগী দেখেননি বলেও জানান তিনি।

আগেও দুইবার আগুন লেগেছিল :

বুধবার বিকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার হিজলতলা এলাকার প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে বুধবারই এক জন নিহত ও ৩৪ জন দগ্ধ হন। এর আগে ২০১৬ সালে এই কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় দফা আগুন লেগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তারপরও কারখানা মালিক খামখেয়ালি করে শুধু একটি গেট থেকে সব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। এলাকাবাসীর দাবি, কারখানার দুই-তিনটি প্রবেশপথ ও গেট থাকলে এত হতাহতের ঘটনা ঘটত না। শ্রমিকরা আগুনের মধ্যে বের হতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন।

আগুনের সূত্রপাত কীভাবে :

আগুন লাগার কারণ এখনো কেউ বলতে পারেনি। তবে কারখানার শ্রমিকদের ধারণা, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লাগতে পারে। অগ্নিকাণ্ডের পর কথা বলার জন্য মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান জানান, এর আগেও কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার আগুন লাগার পর বিকাল ৪টা ২৯ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে পৌনে দুই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

কী তৈরি হতো, কাজ করত কত শ্রমিক :

জানা গেছে, কারখানাটিতে বিরিয়ানির প্লেট, প্যাকেট ও একবার ব্যবহার উপযোগী (ওয়ান টাইম ইউস) গ্লাস তৈরি করা হয়। পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম কারখানাটির মালিক। কারখানায় কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০০। যে ইউনিটে আগুন লাগে, সেখানে ৮০ জন কর্মরত ছিলেন। তারাই দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধ ব্যক্তিদের ১০ জনের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, দগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে আলম, জিনারুল ইসলাম, ফারুক, মেহেদী ও রাজ্জাকের শরীরের শতভাগ পুড়ে গেছে। ৯০ শতাংশ পুড়েছে দুর্জয় ও সুজনের। ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়েছে ১০ জনের।

নিহতের পরিবার ১ লাখ, আহতরা পাবেন ৫০ হাজার :

অগ্নিদুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার ১ লাখ টাকা এবং আহত প্রত্যেকের চিকিত্সার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা ঘোষণা করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে এ সহায়তা করা হবে বলে গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

তবে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত চিকিত্সাধীন সব রোগীর চিকিত্সা ব্যয়ভার সরকারিভাবে বহন করার ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অগ্নিদগ্ধ আহত ব্যক্তিদের চিকিত্সা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিদগ্ধ চিকিত্সাধীন সব রোগীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। বেঁচে থাকা আহত ও অগ্নিদগ্ধ সব রোগীর চিকিত্সা ব্যয় সরকারিভাবেই বহন করা হবে।’

শ্রম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি :

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকের মাধ্যমে উক্ত এলাকায় গত বছর কতগুলো প্লাস্টিক কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে, এ সব পরিদর্শনের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, না হয়ে থাকলে তার কারণ এবং ঐ এলাকার প্লাস্টিক কারখানার ঝুঁকি নির্ধারণ, ঝুঁকি নিরসনের সুপারিশ দিতে এই কমিটি কাজ করবে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন যুগ্ম সচিব এ টি এম সাইফুল ইসলাম, শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক আমিনুল ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ঢাকার উপ-মহাপরিদর্শক আহমেদ বেলাল এবং একই অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিচালক কামরুল হাসান।

পুড়ে অঙ্গার ছেলের মরদেহ ব্রেসলেট দেখে চিনলেন বাবা :

আগুনে ঘটনাস্থলে নিহত একজনের মরদেহ বুধবার থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে ছিল। অনেকেই মর্গে মরদেহের মুখ দেখলেও কেউ চিনতে পারছিলেন না। অবশেষে গতকাল তার বাবা গুলজার হোসেন তাকে চিনতে পেরেছেন। তবে মুখ দেখে নয়, ছেলের বাম হাতের ব্রেসলেটটি দেখে মরদেহ শনাক্ত করেছেন তিনি। নিহতের নাম মাহবুব (২৫), বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। গত ৫ বছর ধরে তিনি কেরানীগঞ্জের প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে মেশিন অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

গুলজার হোসেন বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) সন্ধ্যার পর থেকে মাহবুবকে ফোন দিচ্ছি, রিং বাজে কিন্তু কেউ ধরে না। এরপর রাতে ফোন বন্ধ পেলাম। রাতেই আমার এক ভাতিজা ফোন দিয়ে বলল, ছেলে যে কারখানায় কাজ করত সেখানে আগুন লেগেছে। সেই সংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যালে আসি। সেখানে ব্রেসলেটটি দেখে ছেলেকে চিনতে পারি।

নিহত ১৩ জনের পরিচয় :

বাবলু হোসেন (২৬)। তিনি ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। তার বাড়ি নরসিংদীর বেলাবোর বিন্নাবাইদ গ্রামে। পিতা মৃত তোফাজ্জল হোসেন; সালাউদ্দিন (৩২)। মেশিনম্যান্টাইনার্স ছিলেন। পিতা আব্দুস সালাম। বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মুসাজানে; আব্দুল খালেক খলিফা (৩৫)। ছিলেন মেশিন অপারেটর। পিতা মৃত ইব্রাহিম খলিফা। বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের কৃষ্ণকাঠি গ্রামে; জিনারুল ইসলাম মোল্লা (৩২)। সিনিয়র অপারেটর ছিলেন। পিতা মোতালেব মোল্লা। বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার ছয়ঘরিয়া গ্রামে; জাহাঙ্গীর (৫২)। ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। পিতা মৃত নুরুল ইসলাম; মো. ইমরান (১৮)। পিতা আনছার হাওলাদার। বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া; সুজন (১৯)। পিতা খলিল হোসেন; মো. আলম (২২) ও আব্দুর রাজ্জাক (৪৫)। দুই ভাইয়ের পিতা মৃত আব্দুর রশিদ। বাড়ি কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া; রায়হান বিশ্বাস (১৬)। পিতা ইউসুফ বিশ্বাস। বাড়ি নড়াইল সদর; ফয়সাল (২৯)। পিতা হানিফ দেওয়ান। বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ির উত্তর রায়পুর গ্রামে। তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা; মেহেদী হোসেন (২০)। পিতা আলী হোসেন; মাহাবুব (২৫)। পিতা গুলজার হোসেন। পেশায় রিকশা চালক। বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়।

Bootstrap Image Preview