Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসননামা

তানজীম শহীদ শান্ত
প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:২৯ PM
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:২৯ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


বিতর্ক এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প- যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত বিতর্ক সৃষ্টিকারী প্রেসিডেন্ট মনে হয় আর একটিও নেই। সোশ্যাল মিডিয়াতে আক্রমণাত্মক স্ট্যাটাস কিংবা ছবি পোস্ট করা থেকে শুরু করে মার্কিন কংগ্রেস- সবখানেই তার বিচরণের মাঝে রয়েছে উদ্ভট আচরণ।

ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন শব্দটির সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিচয় পুরনো। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হবার পরপরই গুঞ্জন শোনা যায় যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হবার পেছনে সহায়তা করেছে রাশিয়া সরকার। এমনকি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য দেয় যে, হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য রাশিয়া গোপন ষড়যন্ত্র করেছিল। সত্য অন্বেষণের উদ্দেশ্যে এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি তদন্ত শুরু করেন। কিন্তু এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এফবিআই পরিচালককেই বরখাস্ত করে দেন। তার এমন পদক্ষেপের কারণে সমালোচনা তাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বিষয়টি কংগ্রেসের উপর ছেড়ে দেওয়ার পর কয়েক মাস আগে তাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হয়। অর্থাৎ, অভিশংসনের ছোবল থেকে কোনমতে বেঁচে ফেরেন তিনি। এরই রেশ কাটতে না কাটতেই আবার অভিসংশনের ঝুঁকির মুখে পরার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

অভিশংসন বিতর্ক

এবারের বিতর্কে তার সাথে যুক্ত হয়েছে যার নাম, তিনি হলেন আসন্ন ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারই সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন; যিনি কিনা বারাক ওবামার শাসনামলে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর বিতর্কের কারণ? কারণ লুকিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত দেশ ইউক্রেইনে। বিতর্কের গভিরে লুকিয়ে আছে তেল ও গ্যাস ব্যবসার স্বার্থ।

আরেকটু সহজ ভাষায় যদি বলি, জো বাইডেনের পুত্র হান্টার বাইডেন  ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অভিযোগ ছিল যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যেন তারা বাইডেন পরিবারের কথিত 'দুর্নীতির' ব্যাপারে তদন্ত করে। ট্রাম্প চাপ প্রয়োগের কথা অস্বীকার করলেও তিনি এটা স্বীকার করেছেন যে জুলাই মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে ফোনালাপের সময় তিনি জো বাইডেন এবং তার ছেলে হান্টারের 'দুর্নীতির' প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।

ট্রাম্প-বাইডেন দ্বন্দের বিস্তারিত 

২০১৪ সালে বারাক ওবামার শাসনামলে জো বাইডেন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই সাথে ইউক্রেনের ব্যাপারে মার্কিন নীতি কি হবে তার একজন মুখ্য নির্ধারকও ছিলেন তিনি। এই সময় তার ছেলে হান্টার বাইডেন ইউক্রেনের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি বুরিসমার পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। যার কারণে সবার মনে একই প্রশ্ন ছিল, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের ছেলে যদি ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানির পরিচালক হন - তাহলে বাইডেনের পক্ষে পক্ষপাতহীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে কি না। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত স্বার্থ কি রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে সংঘাত ঘটাবে কিনা।

তৎকালীন সময়ে ইউক্রেন এক বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী   রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকভিচ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এবং পরে রাশিয়ায় নির্বাসিত হয়েছেন। লক্ষণীয় ব্যপার হচ্ছে, সেই সময়টাতেই জো বাইডেন প্রায়শই ইউক্রেন সফরে যাচ্ছিলেন।

পরবর্তীতে ২০১৬ সালে জো বাইডেন ইউক্রেন সরকারের ওপর চাপ দিয়েছিলেন  যেন তারা তাদের প্রসিকিউটর জেনারেল ভিক্টর শোকিনকে বরখাস্ত করে। তার কথামত ইউক্রেন সরকার ভিক্টর শোকিনকে বরখাস্ত করেও দেয়। ইউক্রেন সরকারের ওপর চাপ দেওয়ার ঘটনাটি  বাইডেন নিজেই এক বক্তৃতায় বেশ গর্ব করে স্বীকার করেছিলেন।

বক্তৃতার কিছু কথা ছিল এমন, "আমি ওদের (ইউক্রেনীয়দের) বললাম, আমি এখানে ৬ ঘন্টা আছি। তোমরা যদি শোকিনকে বরখাস্ত না করো, তাহলে তোমাদের যে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ পাবার কথা, তা দেয়া হবে না।"

অনেকটা হুমকির সুর ছিল তার কথার মাঝে। আর এই হুমকির কারণ হলো বুরিসমা কোম্পানির মালিকের দুর্নীতির তদন্ত করছিলেন এই ভিক্টর শোকিন। আর এখানেই ডোনাল্ড  ট্রাম্পের অভিযোগ। তার মতে,  বাইডেন পরিবারের দুর্নীতির চিত্র যাতে সবার সামনে না আসে এজন্য জো বাইডেন জন্যেই এমন কাজ করেছিলেন।   

এবার আসা যাক মূল কথায়। আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের অবস্থানকে আরেকটু পাকাপোক্ত করতে এবং তারই সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাট মনোনয়নপ্রত্যাশী জো বাইডেনকে কাবু করতে এক নতুন চাল চেলেছেন ট্রাম্প। এবছরের ২৫ জুলাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সাথে ফোনালাপের সময় তিনি জো বাইডেন এবং হান্টার বাইডেনের দুর্নীতির ব্যপারে তদন্ত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এছাড়াও, ফোনালাপের দিন কয়েক আগেই এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের ৪০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা ক্ষমতাবলে আটকে দিয়েছিলেন।

এগুলো জানা যায় সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে। এমনকি অভিযোগ উঠেছে, হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা ট্রাম্প-জেলেনস্কির ওই ফোনালাপ গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন। আর এখানেই খেপেছেন ডেমোক্র্যাটস্রা। তাদের অভিযোগ, বাইরের একটি রাষ্ট্রকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্প এই ব্যপারটাকে আরেকটি ‘উইচহান্ট’ বলে অভিহিত করছেন, কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের এত বড় অভিযোগ তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। আর তাই, অভিযোগের সূত্রধরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের তদন্ত শুরু করেছে কংগ্রেস।

অভিশংসন নিয়ে তদন্তের বিস্তারিত

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ব্যতিত সাধারণ আমেরিকানদের রাজনীতি নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই। কিন্তু অভিশংসন তদন্ত নিয়ে গোটা আমেরিকানবাসী বেশ নড়েচড়ে বসেছেন। সিএনএনের জরিপ অনুযায়ী, প্রায় সব আমেরিকানেরই অভিশংসন তদন্ত নিয়ে নিজস্ব মতামত রয়েছে। সবার মনেই একই প্রশ্ন, ‘ট্রাম্প কি শেষমেশ অভিশংসিত হচ্ছেন?

তদন্তের অগ্রগতি দেখে বলার সুযোগ নেই ট্রাম্প অভিশংসিত হবেন কিনা। তবে প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ডেমোক্র্যাটরা নিম্নকক্ষে অভিশংসনের প্রস্তাব পাস করাতে পারবেন বলে দৃঢ়বিশ্বাসী। আর তদন্তের প্রতিবেদনটি সামনে আসার সাথে সাথেই বিষয়টি আরও ভালভাবে বোঝা যাবে। যদি ডেমোক্র্যাটরা নিম্নকক্ষে অভিশংসনের প্রস্তাবটি পাস করাতে পারে তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প হবেন আমেরিকার ইতিহাসের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, যিনি এই অসম্মানজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবেন। সর্বশেষ অভিশংসিত হয়েছিলেন বিল ক্লিনটন ১৯৯৮ সালে। তারও অনেক আগে ১৮৬৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনকেও পরতে হয়েছিল এমন পরিস্থিতিতে।  

ট্রাম্পের অভিশংসন নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান

পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, নিম্নকক্ষে ডেমোক্র্যাটরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার কারণে ডেমোক্রেটিক দলের পক্ষে বেশ শক্ত একটি প্রতিবেদনই দাখিল করা সম্ভব, যার ওপর দাঁড়িয়ে তারা প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসন প্রস্তাব পাস করিয়ে নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁরা অন্তত একজন রিপাবলিকানকে পাশে পাবেন। তিনি হলেন ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচিত মিশিগান থেকে রিপাবলিকান দলের হয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি জাস্টিন অ্যামাশ, চলতি বছরের শুরুর দিকে রিপাবলিকান দল ত্যাগ করেন। তবে ডেমোক্র্যাটরাও তাঁদের ১৮ জন সদস্যকে বিরোধী পক্ষে অবস্থান নিতে দেখতে পারেন। প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাব পাসে এটি বড় ব্যবধান না গড়লেও, সিনেটে প্রস্তাব পাসে এটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দেবে। কারণ সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৬৭টি ভোট নিয়ে প্রস্তাবটি পাস করতে হলে, রিপাবলিকান দলের অন্তত ২০ জন সদস্যকে নিজ দলের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে। এ হিসাবে দাঁড়িয়ে ডেমোক্র্যাটদের রণেভঙ্গ দেওয়াই উচিত। কিন্তু তাতে বাধ সাধছে, খোদ সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককোনেল। প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসনের পক্ষে প্রস্তাব পাস হলে তিনি ‘বিচারকাজ’ শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তবে ডেমোক্র্যাটদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, মার্কিন সামরিক বাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরাও তাদের পক্ষে থাকার সম্ভাবনা বিস্তর। তবে সেটা প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন নয়, নীরব সমর্থন বলা চলে। প্রথমত, অভিযোগ রয়েছে যে ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত সামরিক সহায়তা তহবিলটি দেওয়ার শর্ত হিসেবে ট্রাম্প ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং অনেকটাই মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বিপক্ষে। ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা তো বলার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, কয়েকদিন আগে একজন যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর জন্য নৌমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার কারণে সামরিক বাহিনীর চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন তিনি।

সবদিক বিবেচনা করলে, ট্রাম্পের সামনে অভিশংসন ঝুঁকি ছাড়াও বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যদিও ট্রাম্প বিষয়গুলিকে পাত্তা না দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছেন, অন্তত তার সোশ্যাল মিডিয়ার স্ট্যাটাস কিংবা ছবিগুলো তো তাই বলে। কিন্তু বারবার অভিশংসন বিতর্কে নাম জড়ানো এবং তা থেকে কোনোভাবে গা বাঁচিয়ে পার পাওয়া একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে আবারো বসানো উচিত হবে কি না, নিশ্চয়ই বিষয়টি ভেবে দেখবেন দেশটির সাধারণ মানুষ। তারপরও যদি আগামী বছর নির্বাচনে ট্রাম্প পুনর্বার জয়ী হয়েই যান, তবে তার স্বেচ্ছাচারিতা আরো বেশি মাত্রা ছাড়াবে তা কমবেশি সবাই অনুমান করতে পারছে। এখন দেশটির কংগ্রেস ট্রাম্পের ব্যপারে কি সিদ্ধান্ত নেয় আর দেশটির জনগণ এতকিছুর পরেও আবার ট্রাম্পকেই নির্বাচিত করে কিনা-সেটাই দেখার বিষয়।

 

Bootstrap Image Preview