Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৪ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

একাধিক বিষয়ে ফেল করা সেই ছাত্র এখন বিসিএস ক্যাডার!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:২৪ PM
আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:২৪ PM

bdmorning Image Preview


একসময়ের পড়ালেখায় দুর্বল, পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেল করা, পেছনের বেঞ্চে বসা দরিদ্র পরিবারের সেই ছেলেটি এখন বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা। এখন তাকে নিয়ে এলাকাবাসী গর্ব করেন। তিনি হলেন বিদ্যুৎ কুমার রায়। বাবার নাম হরেন্দ্রনাথ রায়। পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার প্রত্যন্ত উত্তর মেন্দার বাসিন্দা তিনি।

১৯৭৫ সালে এ উপজেলার উত্তর মেন্দা এলাকায় হতদরিদ্র সূত্রধর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিদ্যুৎ কুমার। বাবা পেশায় ছিলেন একজন সাইকেল মেকার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। অর্থের অভাবে তার বাবা হরেন্দ্রনাথ ছেলেকে পড়ালেখার খরচ, বই-খাতা-কলম ও পোশাক জোগাড় করে দিতে পারতেন না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় শত বাধা অতিক্রম করে তিনি আজ বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন।

বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্টের টিচার ট্রেনিংয়ে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত। তার লেখা রসায়ন বইটি ৯ম-১০ম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে।

জানা যায়, বিদ্যুৎ কুমার শরৎনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৯০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় গণিতে লেটার নিয়ে ভাঙ্গুড়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২য় বিভাগে পাস করেন এবং ১৯৯৮ সালে হাজী জামাল উদ্দীন ডিগ্রি কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন।

পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়ে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর নিয়ে ১৯৯৬ সালে বিএসসি (সম্মান) ১ম শ্রেণিতে ২য় হন ও ১৯৯৭ এমএসসিতে ১ম শ্রেণিতে ১ম হন। এ জন্য তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেল ও বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কারে ভূষিত হন।

বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা বিদ্যুৎ কুমার রায় (সহযোগী অধ্যাপক রসায়ন) তার অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিকের ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সব শ্রেণিতেই অংক ও ইংরেজি বিষয়ে তিনি ফেল করেছিলেন। মানুষ পাস করে উপরের ক্লাসে উঠতো আর তিনি ফেল করেই উপরের শ্রেণিতে উঠতেন। তিনি ফেল করেলেও তার মা শিক্ষকদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন তাকে উপরের শ্রেণিতে তুলে দিতেন। স্কুলে পড়ালেখা কিছুই পারতেন না। এ কারণে বসতে হতো তাকে পেছনের বেঞ্চে। কোনো রকমে পুরোনো পোশাক আর পুরোনো স্যান্ডেল পরে স্কুলে যেতেন। সহপাঠীরা প্রায়ই তাকে মারধর করতো। কিন্তু কাউকেই তিনি কিছুই বলতেন না। কারণ ওই সময় তিনি মনে করতেন যে, গরিবদের সঙ্গে অন্যরা এমনই আচরণ করে। ক্লাসে পড়া না পাড়ার কারণে শিক্ষকের কাছে প্রায়ই তিনি বকা খেতেন। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ফজলু স্যার তাকে একদিন দ্রুত হাতের লেখা লিখতে পারলে চকলেট দেবে বললে তিনি দ্রুত হাতের লেখা লিখতে আয়ত্ব করেন। এরপর থেকে তার সঙ্গে দ্রুত লিখতে অনেকেই পারতেন না।

এভাবে এসএসসিতে টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজি ও অংকে ফেল করে নারান ও ধীরন স্যারের কাছে পড়ে তিনি ১৯৯০ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৯০-১৯৯১ শিক্ষাবর্ষে হাজী জামাল উদ্দীন ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে বই কিনতে পারেননি। ক্লাসে পড়া ধরলে শিক্ষকে বলতেন বই কিনতে পারিনি তাই পড়া হয়নি। তাই কলেজের শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় তাকে বই দিয়ে সহায়তা করতেন। এভাবেই এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেন তিনি। আশা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে কিন্তু মানুষ বলতো তোমার বাবা সাইকেলের মেকার তাই সাইকেল সেড়েই খাও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ জোগাতে পারবে না। ওই আশা ছেড়ে দাও। তাই সবার কথা শুনে জামাল উদ্দীন ডিগ্রি কলেজে বিএসএসে ভর্তি হন। সেখানে ফ্রি পড়ার আবেদন করলে হাফ ফ্রি পড়ার আবেদন মঞ্জুর হয়। কিন্তু তার চেয়ে বড়লোকের ঘরের সন্তানরা পায় ফুল ফ্রি আর তিনি পান হাফ ফ্রি। মনে এ কষ্ট নিয়ে তিনি মনস্থির করেন যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করবেন। তাই তিনি এক বছর বাদ দিয়ে পরের বছর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর থেকে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম ও শ্রমের বিনিময়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে পড়ার সুযোগ লাভ করেন।

সেখানে ছাত্রজীবনে প্রচুর পড়াশোনার মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়েছেন। এমনকি পড়ালেখা ছাড়া অন্য কোনো জগৎ তিনি জানতেন না। সেই কারণেই তিনি ১৯৯৬ সালের বিএসসি (সম্মান) ১ম শ্রেণিতে ২য় ও ১৯৯৭ সালের এমএসসি পরীক্ষায় রেকর্ড পরিমাণ নম্বর ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান লাভ করেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেল ও বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কারে ভূষিত হন।

তিনি আরও বলেন, ছাত্রজীবনে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেলে গরিব বলে তাকে কেউ খেলা নিতো না। কারণ তারা বলতো, তিনি খেলার কোনো সামগ্রী কিনতে পারবে না। তবে কখনও কখনও তাকে ফুটবল খেলায় গোলকিপার রাখতো। সেখানেও তিনি দেখিয়েছেন দক্ষতা। তার আশপাশ দিয়ে কোনোভাবেই বল যেতে পারতো না। এজন্য তিনি ছিলেন একজন দক্ষ গোলরক্ষক।

এরপর তার অদম্য চেষ্টা ও ইচ্ছার কারণে ২২তম বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্টের টিচার ট্রেনিংয়ে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তবে শনিবার সরকারি ছুটির দিন হলে জন্মভূমি ভাঙ্গুড়ায় ও পাশের উপজেলার এসে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে যান এবং বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়াসহ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেন।

প্রতিটি শিশুর মধ্যেই অদম্য মেধা রয়েছে শিক্ষকরাই পারেন সেটি ফুটিয়ে তুলতে এবং বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনে পৃথিবী শাসন করবে এমন আশা ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, তার মতো বাংলার প্রতিটি ঘরে একজন করে বিসিএস ক্যাডার তৈরি হোক।

Bootstrap Image Preview