Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

এককভাবে রাজত্ব করা এক মুকুটহীন রাজা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৫৪ PM
আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৫৪ PM

bdmorning Image Preview


বাংলা সাহিত্যের একজন কিংবদন্তীর নাম যদি বর্তমান সময়ের ১০ জন ছেলে মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হয় তবে তাদের মধ্যে অকপটে কমপক্ষে ৮ জনই যে নামটা বলবে তিনি নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা বঙ্কিম চন্দ্রের মতো নামকরা কবি সাহিত্যিকরা তাদের নিজ নিজ সময়ে নিজেদের সেরাটা দিয়ে যেমন সাহিত্যপ্রেমীদের মনে আজীবনের মতো একটা জায়গা করে নিয়েছে তেমনি বাংলা সাহিত্যের ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেওয়া হুমায়ূন আহাম্মেদ ছিলেন তার সময়ে এককভাবে রাজত্ব করা এক মুকুটহীন রাজা।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার মোহনগঞ্জে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন নন্দিত এই কথা সাহিত্যিক। ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান; ডাকনাম ছিল কাজল। হুমায়ূন আহাম্মেদের পিতা ফয়জুর রহমান ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। কে জানে সাহিত্যে পদচারনার অনুপ্রেরণাটা হয়তোবা তিনি পেয়েছিলেন বাবার কাছে থেকেই।

বাবা সরকারী কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে বাবার বদলির সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছিল তার। তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক এবং স্নতকোত্তর শেষ করেন প্রথম শ্রেণী নিয়ে নিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তিনি ছিলেন হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ৫৬৪ নম্বর কক্ষে এবং তার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে এই হলে থাকা অবস্থাতেই তিনি রচনা করেন। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ সফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়।

‘শঙ্খনীল কারাগারে’ উপন্যাসটি তিনি ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস লেখার আগে লিখলেও এটি প্রকাশিত হয় ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের পর। এই দিক থেকে বিচার করলে তার লেখা প্রথম উপন্যাস কিন্তু ‘শঙ্খনীল কারাগারে’। হুমায়ূন আহাম্মেদ কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে, ৬৫০ টাকার বেতনের।

১৯৭৬ সালে গুলতেকিন খানকে বিয়ে করেন নন্দিত এই কথা সাহিত্যিক। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে নোভা আহমেদ, মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ এবং ছোট মেয়ে বিপাশা আহমেদ। তাঁর বড় ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। অন্য আরেকটি ছেলে সন্তান অকালে মারা যায়। তিনি তার নাম রেখেছিলেন রাশেদ হুমায়ূন।

১৯৯০ সালের মধ্যভাগ থেকে তার কন্যা শীলার সমবয়সী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৩ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এই বিয়ের সাথে সাথে নিজের জীবনে বিতর্কের অবতারণা করেন এই কথার যাদুকর, পরবর্তী সময়ে তাকে নিয়ে হওয়া প্রায় সব বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দু ছিল তার এই বিয়ে।এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। এ কন্যার নাম তিনি রাখতে চেয়েছিলেন লীলাবতী। ছেলেদের নাম নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

হুমায়ূন আহাম্মেদ প্রায় দুসইশত গল্প এবং উপন্যাস রচনা করেছেন তবে শুধু সংখ্যা দিয়ে তার জনপ্রিয়তা কোনভাবেই মাপা যাবে না। বাকের ভাই, হিমু, মিসির আলী সহ আরও অনেক জনপ্রিয় চরিত্রের সৃষ্টি হয়েছিল এই মহান যাদুকরের হাত ধরেই।

চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন হুমায়ূন আহাম্মেদ। ১৯৯৪ সালে ‘আগুনের পরশমণি’ ছায়াছবি দিয়ে তার চলচ্চিত্রের অভিষেক ঘটে। পরবর্তী সময়ে তিনি আরও তৈরি করেছেন শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারি, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া সহ আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। তার সর্বশেষ ছবি ছিল ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ যা মুক্তি পায় ২০১২ সালে।

জীবনের শেষভাগে ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত দখিন হাওয়া ভবনের একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। খুব ভোর বেলা ওঠা অভ্যাস ছিল তাঁর, ভোর থেকে সকাল ১০-১১ অবধি লিখতেন তিনি। মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কখনো অবসর পেলে ছবি আঁকতেন। ২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারী চিকিৎসার সময় তাঁর দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯শে জুলাই ২০১২ তারিখে তিনি নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দাফন করা হয় নুহাশ পল্লীতে।

বেঁচে থাকতে যারা তার পারিবারিক জীবন নিয়ে সারাক্ষন সমালোচনায় লিপ্ত থাকতেন তার চলে যাওয়ার পর তারাও অনেকটাই অনুধাবন করতে পেরেছেন বাংলা সাহিত্য কি হারিয়েছে? তার মৃত্যুর পর একুশে বইমেলার ফাঁকা স্টলগুলো যেন সে কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেন। হাজারো ভক্তকে কাঁদিয়ে এই কথার যাদুকর চলে গেছেন না ফেরার দেশে, আমাদের মন হাজারো কাঁদলেও কোনও বর্ষাতেই আর চলে আসবেন না তিনি।

আজ এই মহান যাদুকরের জন্মদিনে শুধু এই কথাতাই বলতে চাই, জাতিগত একটা বদ অভ্যাসের কারণে আপনাকে আমরা আপনার যথেষ্ট সন্মান কখনই দিতে পারি নি বরং আপনার বাক্তিগত জীবন নিয়ে করেছি নানা টানা হেঁচড়া। তবে এই নন্দিত কথা সাহিত্যিকের মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে আসলেই মনে হয় ‘কোথাও কেউ নেই’।

Bootstrap Image Preview