সাজসজ্জা নারীর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ। নারীর সাজসজ্জার ব্যাপারে ইসলাম উদারতা দেখিয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো—
জামার ব্যাপারে বিধান
টাইটফিট বা মিহি জামা পরে বাইরে বেরোনো কোনো মুসলিম নারীর পক্ষে শোভা পায় না। কারণ অন্যের সামনে নারীর সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা ফরজ। আর এসব জামায় পর্দা লঙ্ঘিত হয়। হজরত আলকামা ইবনে আবু আলকামা তাঁর মা থেকে বর্ণনা করেন, ‘একবার হাফসা বিনতে আবদুর রহমানের ফুফু উম্মুল মোমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাছে এলেন। তখন তাঁর পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। উম্মুল মোমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) তা ছিঁড়ে ফেলেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন।’ (মুয়াত্তা মালেক : ২/৯১৩)
আবু ইয়াজিদ মুজানি (রহ.) বলেন, ‘হজরত ওমর (রা.) নারীদের কাবাতি (মিসরে প্রস্তুত এক ধরনের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বলল, এ কাপড়ে তার ত্বক দেখা যায় না। তিনি বলেন, ত্বক দেখা না গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২৫২৮৮)
তবে টাইট ও মিহি পোশাক নারীরা একান্তভাবে স্বামীর সামনে পরতে পারবে। নিউ মডেল বা ফ্যাশনের জামাকাপড় পরিধান করা তখনই বৈধ হবে, যখন তা পর্দার কাজ দেবে এবং তাতে কোনো কাফিরের অনুকরণ না হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) আমাকে ‘উসফুর’ (ছোট ধরনের লাল বর্ণের ফুল) দ্বারা রাঙানো দুটি কাপড় পরতে দেখে বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে কাফিরদের পোশাক; অতএব তুমি তা পরিধান করবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০৭৭)
জুতার বিধান
অতিরিক্ত উঁচু সরু হিল তোলা জুতা ব্যবহার নিষিদ্ধ। কারণ এগুলো পরে চলাচল করলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় ও তাদের কুরিপুকে প্রলুব্ধ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যেন নিজেদের ভূষণ প্রকাশ না করে।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩১)
তা ছাড়া এসব জুতা পরলে চলাফেরায় সমস্যা হয়। অনেক সময় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
চুলের বিধান
নারীদের চুলে বেণি বা ঝুঁটি গেঁথে মাথা বাঁধা উত্তম। চুল বেশি বা লম্বার আন্দাজ যেন পরপুরুষ না করতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা নারীর কর্তব্য। কারণ নারীর সুকেশ এক সৌন্দর্য, যা পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করা হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শেষ জমানার আমার উম্মতের মধ্যে কিছু এমন লোক হবে, যাদের নারীরা হবে অর্ধনগ্ন। তাদের মাথা কৃশ (খোঁপা) উটের কুঁজের মতো হবে। তোমরা তাদের অভিশাপ করো, কারণ তারা অভিশপ্ত।’
চুল বেশি দেখানোর উদ্দেশ্যে কৃত্রিম চুল বা পরচুলা ব্যবহার করা হারাম। স্বামী চাইলেও তা মাথায় লাগানো যাবে না। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন ওই সব নারীর ওপর, যারা পরচুলা লাগিয়ে দেয় এবং যে পরচুলা লাগাতে বলে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৩৭)
খেজাবের বিধান
সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নারীরা কালো খেজাব ছাড়া অন্যান্য খেজাব দিয়ে চুল রাঙাতে পারে। ফ্যাশনের জন্য চুল ছোট ছোট করে কাটা বৈধ নয়। তবে চুলের অগ্রভাগ এলোমেলো হলে সামান্য কাটতে পারে। কিন্তু না কাটাই উত্তম। কেননা বেশি চুল নারীর সৌন্দর্য।
ভ্রু প্লাক ও নকশা আঁকা
স্বামী চাইলেও কপালের পশম চাঁছা ও ভ্রু প্লাক করা জায়েজ নেই। কেননা এর দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন করা হয়, যার অনুমতি ইসলামে নেই। এভাবে মুখে বা হাতে সুই ফুটিয়ে নকশা আঁকা বা ট্যাটু করা বৈধ নয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক ওই নারীদের ওপর, যারা দেহাঙ্গে উল্কি উত্কীর্ণ করে এবং যারা করায়, যারা ভ্রু চেঁছে সরু (প্লাক) করে ও যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধির মানসে দাঁতের মধ্যে ফাঁক সৃষ্টি করে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৮৮৬)
তবে পুরুষের দাড়ি-গোঁফের মতো নারীর গালে বা ঠোঁটের ওপর পশম থাকলে তা তুলতে দোষ নেই।
নাক বা কান ফুঁড়িয়ে গয়না পরিধান করা
মহিলার নাক বা কান ফুঁড়িয়ে তাতে অলংকার ব্যবহারের ব্যাপারে ইসলামে বৈধতা রয়েছে। এভাবে গলায় হার বা পায়ে নূপুর পরাও বৈধ। তবে যদি নূপুরে বাজনা থাকে, তাহলে ঘরের বাইরে পরপুরুষের সামনে তা পরে হাঁটাচলা করা জায়েজ নেই।
প্রসাধনী ব্যবহারের বিধান
হারাম বস্তু ও ক্ষতিকর পদার্থমুক্ত লিপস্টিক, মেকআপ, স্নো, পাউডার প্রভৃতি অঙ্গরাজ ব্যবহার বৈধ। নিজেকে সর্বদা সুরভিত করে রাখায় নারীত্বের এক আনন্দ আছে। এ জন্য স্বামীর কাছে যাওয়ার আগে অ্যালকোহল ও হারাম স্পিরিটমুক্ত সেন্ট-পারফিউম ব্যবহার নারীর জন্য জায়েজ, বরং উত্তম। নখে নেইলপলিশ ব্যবহারও জায়েজ। তবে অজুর আগে তা তুলে ফেলা আবশ্যক। না তুললে অজু হবে না। এটি ব্যবহারের উত্তম সময় হলো মাসিকের দিনগুলোতে। কেননা তখন অজু-গোসল করতে হয় না।
মেয়েদের হাত-পা ও নখ সর্বদা মেহেদি দিয়ে রাঙিয়ে রাখা উত্তম। কেননা এতে স্বামীর দাম্পত্য জীবনে তৃপ্তি আনে। আর অজু-গোসলের সময় তা কষ্ট করে তুলে ফেলার ঝামেলাও নেই। কারণ নেইলপলিশের মতো এতে কোনো আবরণ নেই।
হাত-পায়ের নখ বড় রাখা বিজাতীয়দের স্বভাব ও একটি ঘৃণিত কাজ। অনেক সময় নখের ভেতর ময়লা জমে খাবারের সময় পেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রতি সপ্তাহে হাত-পায়ের নখ কাটা সুন্নত।
চিরনদাঁতির বিধান
দাঁত ঘষে ফাঁক করা ও চিরনদাঁতির রূপ আনা জায়েজ নেই। অবশ্য কোনো দাঁত অস্বাভাবিক ও অশোভনীয়ভাবে বাঁকা বা অতিরিক্ত থাকলে তা সোজা করা বা তুলে ফেলা বৈধ। কোনো বিকৃত অঙ্গে সৌন্দর্য আনয়নের জন্য অস্ত্রোপচার বৈধ। এভাবে অতিরিক্ত আঙুল বা মাংস হাতে বা দেহের কোনো অঙ্গে লটকে থাকলে তা কেটে ফেলা জায়েজ। কিন্তু ত্রুটিহীন অঙ্গে অধিক সৌন্দর্য আনয়নের উদ্দেশ্যে অস্ত্রোপচার করা জায়েজ নয়।
মনে রাখতে হবে, সৌন্দর্যবর্ধনে যেসব উপকরণের ব্যবহার ইসলামে বৈধ, তা অপচয় করা কিংবা তা নিয়ে পরস্পর গর্ব করা জায়েজ নেই। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যা ইচ্ছা খাও, পান করো ও পরিধান করো। তবে যেন তাতে দুটি জিনিস না থাকে—অপচয় ও গর্ব।’ (বুখারি : ১০/১৫২)
লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতু ইলয়াস আল ইসলামিয়া টঙ্গী, গাজীপুর