ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য প্রধান হাতিয়ার হবে তথ্য প্রযুক্তি। আর তাই দেশের প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার হাতে নিয়েছে ‘ভিশন ২০৪১’। সরকারের এই মহৎ উদ্যোগকে আরও ত্বরান্বিত করতে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত ও তুলনামূলক সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিজস্ব উদ্যোগে গঠিত ‘বাইনারী ক্লাব’। দেশের সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলসহ সকল স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে জনপ্রিয় করা এবং প্রযুক্তি বিষয়ক বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয়টিকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজভাবে উপস্থাপণ করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
পথে চলতে চলতেই ২০১৮ সালের প্রথম দিকে শুরু হয় বাইনারী ক্লাব নামক অলাভজনক এই সংস্থাটির কার্যক্রম। ‘Learn IT, lead future’ স্লোগান নিয়ে দেশের প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অবদান রাখতেই কাজ শুরু করে সংস্থাটির উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র অল্প সংখ্যক ছাত্র মিলে সম্পূর্ণ নিজেদের খরচে সূচণা করে দেশের সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কাছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে (আইসিটি) সহজভাবে উপস্থাপণ করার কাজটি। এরপর গুটি গুটি পায়ে চলতে চলতেই সংস্থাটির সাথে আস্তে আস্তে যুক্ত হয় দেশের আরও সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেখতে দেখতে বাড়তে থাকে সংস্থাটির কাজের পরিধিও।
তবে শুরুর পর থেকে এক বছরের বেশি সময় পেড়িয়ে গেলেও এখনো সংস্থাটির কার্যক্রম চলছে শুধুমাত্র এর উদ্যোক্তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কতিপয় শিক্ষার্থীদের নিজেদের খরচেই। এখন পর্যন্ত তারা পায়নি কোনো ধরণের অনুদান বা আর্থিক সহযোগিতা। তবে এত বাধার মুখেও তাদের ইস্পাত কঠিন মনোবল ভেঙে পড়ার মতো নয়। শত বাধার মুখেও কাঁধে তুলে নেয়া গুরু দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে যেতে চায় সংস্থাটির উদ্যোগতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান মোঃ রাকিব উন নবী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রযুক্তির দিক থেকে দেশের শহরাঞ্চলে উন্নতি সাধন হলেও পিছিয়েই থেকে যাচ্ছে অনুন্নত ও সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলগুলো। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই উঠে আসছে সেই পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলো থেকে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে প্রবেশের পর থেকে প্রযুক্তিকে বোঝার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে প্রযুক্তির ছোট ছোট বিষয়গুলোর জ্ঞানার্জন করতেই তাদের লেগে যাচ্ছে বড় একটি সময়। অপরদিকে, তারা যদি স্কুল বা কলেজেই সেই জ্ঞানটুকু অর্জন করতে পারতো তাহলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছোট ছোট বিষয়গুলোর পেছনে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হতো না।
এছাড়াও তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার দেশকে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ করতে স্কুল কলেজেও প্রযুক্তি বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক পাঠ্য করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে দক্ষ শিক্ষক ও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রযুক্তি বিষয়টি দুর্বোধ্যই থেকে যাচ্ছে। প্রযুক্তি প্রীতির পরিবর্তে তাদের মাঝে জন্ম নিচ্ছে প্রযুক্তি ভীতি। ফলে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ অকৃতকার্য হচ্ছে আইসিটি বিষয়টিতে।
সংস্থাটির কার্যক্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের যে সব অঞ্চল গুলোতে আইসিটি বিষয়টির দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে বেশি ভীতসন্ত্রস্ত আমরা সে সব অঞ্চল গুলোতেই বিষয়টিকে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজভাবে উপস্থাপণের কাজ শুরু করি। বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের পাঠ্যক্রমের কঠিন বিষয় গুলোকে একটি কর্মশালা করার মাধ্যমে সহজভাবে উপস্থাপণ করি। কর্মশালায় শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখতে পেরেছে তা বোঝার জন্য তাদের একটি ছোট্ট কুইজ নেয়া হয় এবং ভালো ফলাফলকারীদেকে পুরস্কৃতও করা হয়।
এছাড়াও শিক্ষদের সাথে মাল্টিমডিয়া ক্লাস নেয়াসহ শ্রেণী কক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও পাঠদানকে আনন্দময় করার বিষয়েও আলোচনা সভা হয়ে থাকে। অপরদিকে, কর্মশালায় ‘কম্পিউটার মিউজিয়াম’ নামে একটি অংশ থাকে, সেখানে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটারের ভেতরের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়। এ সময় আমাদের দক্ষ প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রদের কাছ থেকে তারা কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশের কাজ ও সঠিক ব্যবহার সম্পর্কেও ধারণা লাভ করতে পারে। আর কর্মশালা থেকে শুরু করে শিক্ষকদের সাথে আলোচনা সভা ও কম্পিউটার মিউজিয়াম সবই থাকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে! অর্থাৎ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কারো কাছ থেকেই কোনো টাকা নেয়া হয় না।
এ বিষয়ে সংস্থাটির আরেকজন সহপ্রতিষ্ঠাতা ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান তৌহিদ পাপ্পু বলেন, দেশের জন্য কিছু করা এবং দেশের প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অবদান রাখার ইচ্ছা থেকেই আমাদের কার্যক্রমের শুরু। ছোট পরিসরে শুরু করার পর আস্তে আস্তে কাজের পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের। কিন্তু সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নিজেদের অর্থায়নেই পরিচালিত হচ্ছে আমাদের কার্যক্রম। এখনো আমরা পাইনি কোনো আর্থিক সহযোগিতা।
তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে সারাদেশে আমাদের তিনটি শাখা দেয়া হয়েছে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। সারাদেশে প্রায় ২০০ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। খুব শিঘ্রই বাইনারী ক্লাবের পক্ষ থেকে আসতে চলেছে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা।
এছাড়াও আমরা খুবই দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী ও বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যও কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। সেখানে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থাও রাখা হবে।
অপরদিকে, মজার ছলে সংস্থাটির নামের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির অপর এক সহপ্রতিষ্ঠাতা অঙ্গন বলেন, আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের কাছে একটি ভীতিকর বিষয়কে মজার বিষয় হিসেবে তুলে ধরার জন্য কাজ শুরু করেছি তাই আমাদের সংস্থাটিকেই প্রথমে তাদের কাছে মজার হিসেবে উপস্থাপণ করতে হবে। সে লক্ষ্যেই আমরা ‘বাইনারী’ শব্দটির সাথে ‘ক্লাব’ শব্দটিকে যুক্ত করেছি। কারণ শিক্ষা জীবনে একজন শিক্ষার্থীর কাছে ক্লাব বিষয়টি অনেক আপন মনে হয় আর ক্লাবের কোনো প্রোগাম হলে তো আনন্দের সীমা-ই থাকে না।