নীলক্ষেত স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাঈম হাসান ডেঙ্গু জ¦র নিয়ে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হয় গত সোমবার। নাঈম ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও আতঙ্ক কাটছে না মা হাসনা হেনার। তিনি বলেন, রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় রক্ত দিতে হয়েছে। তার ওপর প্রতিদিন নানারকম পরীক্ষা চলছে। একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, যার দাম ৭ হাজার টাকা। তিন দিনে ২১ হাজার টাকা গেছে। ভর্তির পর তিন দিনে শুধু ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো।
চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে অনুরূপ দুশ্চিন্তার কথা জানালেন একই হাসপাতালে ১১৬ নম্বর কেবিনে ভর্তি জয়িতার বাবা ফিরোজ মান্না ও সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসাধীন মুগদাপাড়ার সেলিমের বাবা আবদুস সালাম। তারা দুজনই জানান, দৈনিক ৮-১০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে শুধু ওষুধ কিনতে ও পরীক্ষা করতে। এরপর বেড ভাড়া তো রয়েছেই।
দেশে ডেঙ্গু বিস্তারের পাশাপাশি এবার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর নতুন ধরন ও চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার ধরনের ডেঙ্গুর (ডিইএনভি-১, ডিইএনভি-২, ডিইএনভি-৩ ও ডিইএনভি-৪) মধ্যে এবার ডিইএনভি-৩ ধরনের ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। এ ধরনের রোগীরা এর আগে প্রথম দুই ধরনের মধ্যে যেকোনো এক ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে এবার ডেঙ্গু রোগীদের বেশিরভাগই আসছেন ‘শক সিনড্রোম ডেঙ্গু’ নিয়ে। অর্থাৎ এরা হেমোরেজিক (রক্তক্ষরণ) ও ক্ল্যাসিক (সাধারণ) ডেঙ্গুর সমন্বিত জটিলতা নিয়ে। ফলে এদের শরীরে ‘শক সিনড্রোম’ দেখা দিচ্ছে। এসব রোগীর রক্তচাপ কমে যাচ্ছে, হৃৎপি-ের গতি বেড়ে যাচ্ছে, শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যাচ্ছে। পরে শরীরের পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। ফুসফুস ও পেটে পানি জমছে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এবার ডেঙ্গুর ধরন ভিন্ন। বেশি জটিলতা নিয়ে রোগীরা আসছেন। ফলে তাদের চিকিৎসায় ব্যয় বাড়ছে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একজন ডেঙ্গু রোগীর দৈনিক ব্যয় হচ্ছে গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতিদিন একটা ‘অ্যালবুটিক ইনজেকশন’ কিনতে হচ্ছে ৭ হাজার টাকা করে। জার্মান ও আমেরিকার তৈরি এই ইনজেকশন দেওয়া হয় শরীরের রক্তের প্রোটিন ‘অ্যালবুনিল’ বেশি কমে গেলে। এ ধরনের রোগীরা জটিল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এছাড়া প্রতিবার রক্তের ক্রসম্যাচিং করতে ব্যয় হচ্ছে ১৫০০ টাকা করে। এর বাইরে দৈনিক বেড ভাড়া ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় তো রয়েছেই। এ ব্যয় সরকারি হাসপাতালের তুলনায় ৫-৭ গুণ বেশি। অর্থাৎ একজন ডেঙ্গু রোগীর সরকারি হাসপাতালে ব্যয় হচ্ছে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সরকারের দেওয়া গাইডলাইন ঠিকমতো মানা হচ্ছে না। গাইডলাইন
অনুযায়ী চিকিৎসা হলে এত ব্যয় হওয়ার কথা না। সাধারণত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সচ্ছল রোগীরা ভর্তি হন। ফলে তারা চান দ্রুত সুস্থ হতে।
অবশ্য রোগীর ধরন অনুপাতে চিকিৎসা দিতে গিয়েই ব্যয় হয়তো কিছুটা বাড়ছে বললেন বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. এ টি এম নজরুল ইসলাম। এই চিকিৎসক বলেন, যে ইনজেকশনের (অ্যালবুটিক) কথা বলা হচ্ছে, সেটা জটিল ডেঙ্গু রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। যেসব রোগীর রক্তের ‘অ্যালবুনিল’ নামে এক ধরনের প্রোটিন মাত্রাতিরিক্ত হারে কমে যায়, তাদের রক্তের প্রোটিন বাড়াতে এটা দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া বাকি সবকিছুই হচ্ছে নিয়মের মধ্যে।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, এবার শুধু রোগীর সংখ্যায়ই বেশি না। এবার প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমারজিক ফিভারে আক্রান্ত। এদের ৫০ ভাগেরই শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু আক্রান্ত যত রোগী আসছে এদের সবার প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, সবাই শকে চলে যাচ্ছে। আগে সামান্য চিকিৎসায় ডেঙ্গু ভালো হয়ে যেত। এবার সবারই রক্ত লাগছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বর হলে গাফিলতি না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
চিকিৎসার ব্যাপারে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ক্ল্যাসিক ডেঙ্গু রোগীদের দৈনিক ২-৩ লিটার সাধারণ ওরস্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। তরল খেতে হচ্ছে ৩ লিটার। ফল ও ফলের রস খেতে হয়। ওষুধের মধ্যে প্যারাসিটামল ও বমি কমার জন্য একটা ওষুধ সেবন করতে হয়। পানিশূন্যতা দেখা দিলে শিরায় আইভি স্যালাইন দিতে হয়। এটার দাম এক থেকে দেড়শো টাকা। তিনি আরও জানান, ডেঙ্গু রোগীদের রক্ত কিনতে হয় না, শুধু বদল করতে হয়। সেজন্য রক্তের ক্রসম্যাচিং করতে ব্যয় হয় ১৫০০-২০০০ টাকা।
ডা. লেলিন আরও বলেন, অ্যালবুটিক ইনজেকশন দিতে হয় জটিল ডেঙ্গু রোগীদের রক্তের প্রোটিন ‘অ্যালবুনিল’-এর ভারসাম্য আনতে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য এ প্রোটিন অল্প কমে গেলে আমরা ডিমের সাদা অংশ খেতে বলি। সে ক্ষেত্রে ইনজেকশন লাগে না।
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া বলেন, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে ১০ টাকা ভর্তি ফি ও ভর্তির ফরম ফি ১৫ টাকা। অর্থাৎ মোট ২৫ টাকা। আমরা প্রথমে ডেঙ্গু শনাক্ত করার জন্য রোগীর রক্তের ‘এনএস১’ পরীক্ষা করি। এটা সব সরকারি হাসপাতালেই বিনামূল্যে হয়। রোগী যদি পাঁচ-ছয় দিনের জ¦র নিয়ে আসে তাহলে রক্তের ‘অ্যান্টিবডি’ পরীক্ষা করি। আর রক্তের প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য ‘সিবিসি’ বা ‘টোটাল ব্লাড কাউন্ট’ করি। এগুলো সব বিনামূল্যেই করা হয়। বাইরে থেকে করালে ‘সিবিসি’র জন্য খুব বেশি হলে ২০০ ও ‘অ্যান্টিবডি’র জন্য ৮০০-১২০০ টাকা খরচ হয়।
অ্যালবুটিক ইনজেকশনের ব্যাপারে এই চিকিৎসক বলেন, সাধারণত যেসব ডেঙ্গু রোগী খুব জটিল, ডেঙ্গুর পাশাপাশি ডায়াবেটিস, কিডনি বা অন্য রোগী আছে, তাদের ক্ষেত্রেই শুধু এই ইনজেকশন লাগে। সব রোগীর ক্ষেত্রে এই ইনজেকশন লাগে না। বাজারে এই ইনজেকশন সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা। তিনি বেসরকারি হাসপাতালে সরকারি গাইডলাইন মানা হচ্ছে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে চিকিৎসকদের জন্য নতুন করে চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে কোন ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, কী ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে আর কী কী ওষুধ বর্জন করতে হবে সে সম্পর্কে গাইডলাইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। সুতরাং সবার উচিত গাইডলাইন মেনে চলা।
সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৪৬ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ১ হাজার ২০৭ জন। এর মধ্যে গত ১ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ০৭৬ জন। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচজন।
সরকারি হিসাবেই গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ২১৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তবে আক্রান্ত ও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকগুণ বেশি বলে জানান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) গবেষকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গবেষক বলেন, আক্রান্তের সব তথ্য কন্ট্রোল রুমে আসছে না। তাছাড়া মৃত্যুর সংখ্যা সঠিক নয়। সরকারি হিসাবের চেয়ে তিনগুণ বেশি রোগী মারা গেছে।