নারীর সৌন্দর্য তার পায়ে- এমনটি মনে করা হতো চীনে। যে নারীর পা যত ছোট, সে তত সুন্দরী। চীনে এমন রীতিই চলে আসছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
ছোট পায়ের নারীদের প্রতি আকর্ষিত হতেন পুরুষরা। যে কারণে এমন নারীকে বিয়ে করতে প্রতিযোগিতায় নামতেন ধনীরা।
ঠিক সে কারণেই ধনীর ঘরে বিয়ে দিতে নির্মমভাবে মেয়েদের পা ছোট করে রাখার কুপ্রথা চালু ছিল প্রাচীন চীনে।
প্রথাটি এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে, কৃত্রিমভাবে পা ছোট রাখতে আঙুল ভেঙে দেয়া হতো তিন-চার বছর বয়সী কন্যাশিশুদের।
চৈনিক ইতিহাস বলছে- পা নরম রাখতে প্রথমে উষ্ণ ভেষজ ও পশুর রক্তে পা ভিজিয়ে রাখা হতো কন্যাশিশুদের। কেটে ফেলা হতো নখ। তার পর ঘটত সেই পৈশাচিক কাণ্ডটি। কোমলমতি কন্যাশিশুদের পায়ের আঙুলগুলো নিচের দিকে বাঁকিয়ে ভেঙে ফেলা হতো। এর পর পরিয়ে দেয়া হতো লোহার জুতা, যেন পা আর না বাড়ে।
হাড় ভাঙার যন্ত্রণায় এসব শিশু কাতরাতে থাকলেও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল না স্বজনদের। শক্ত ব্যান্ডেজে আঙুল ভাঙা পা মুড়ে ফেলা হতো। ব্যান্ডেজ এমনভাবে বাঁধা হতো, যাতে ভাঙা হাড়গুলো কখনই জোড়া না লাগে।
এভাবেই বছরের পর বছর এই ব্যান্ডেজ বাঁধা বিকৃত পা নিয়েই বড় হতে থাকত শিশুরা। এরই মধ্যে তাদের অনেকের পায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ত, কারও কারও রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গিয়ে পায়ে পচন ধরত।
তবু রেহাই পেত না তারা। উল্টো খুশিই হতেন পরিবারের লোকজন। কারণ পায়ে পচন ধরলে আঙুল খসে পড়ে যাবে, তাতে পা আরও ছোট লাগবে।
ইতিহাস বলছে, এসব সংক্রমণ ও পচনের কারণে অনেক তরুণী মৃত্যুবরণ করতেন। তবু থেমে ছিল না এই ভয়ঙ্কর প্রথাটি।
দ্রুত পচনের জন্য অনেকে নাকি ব্যান্ডেজ বাঁধার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে কাপড়ের মধ্যে কাচের টুকরো বা আলপিন লাগিয়ে দিত, যাতে যত দ্রুত সম্ভব পায়ে পচন ধরে।
আঙুল ভেঙে মেয়েদের পা এভাবে ছোট রাখার একটিই উদ্দেশ্য- পুরুষের মন পাওয়া।
মেয়েদের পা ছোট রাখতে বাধ্য করার এই কুপ্রথাটি কবে বা কীভাবে চালু হয়েছিল, সে নিয়ে রয়েছে একটি মিথ।
চীনের ইতিহাস বলছে, ১২৭৯ সালে সং বংশের রাজত্বকালে রাজদরবারের নর্তকীদের মধ্যে প্রথম এ প্রথা চালু হয়। ঐতিহাসিকের মতে, ৯৭৫ সালে ট্যাং বংশের রাজত্বকালের লিখিত পুঁথিতেও পা ছোট রাখার রীতির উল্লেখ রয়েছে।
কথিত আছে, এক নর্তকী সুন্দর, ছোট পা দেখে মোহিত হয়ে যান সেই সময়ে এক রাজা। তার পর থেকেই ছোট পায়ের হিড়িক পড়ে যায়। অভিজাতদের মধ্যেও এ বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর ধনী পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে সাধারণ মানুষেরাও পা ছোট রাখার প্রথায় জড়িয়ে পড়ে।
১৯ শতকের গোড়ার দিকে চীনে মোট নারী জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরই পা ছোট ছিল। শুধু অভিজাতদের মধ্যেই সংখ্যাটি ছিল প্রায় ১০০ শতাংশ। তবে ১৬৪৪ সাল থেকে মাঞ্চু চিং বংশ ক্ষমতায় এলে পা ছোট করে রাখার কুপ্রথা নিষিদ্ধ হয়। তার বদলে নৌকার মতো দেখতে উঁচু হিলের জুতা চালু হয়।
তবু এ প্রথা থেকে ফেরানো যাচ্ছিল না চীনা অধিবাসীদের।
১৯০০ সালের পর থেকে এই নির্মম প্রথার বিরোধিতা করতে শুরু করেন দেশটির মুসলমানরা। রাজতন্ত্রের অবসানের পর চীনে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯১২ সালে আইন করে পা ছোট করার কুপ্রথা নিষিদ্ধ হয়।