Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

রিজার্ভ করে শেয়ারবাজারে ‘ঝড়’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৮ জুন ২০১৯, ০৫:০৭ PM
আপডেট: ১৮ জুন ২০১৯, ০৫:০৭ PM

bdmorning Image Preview


নতুন অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য বেশকিছু প্রণোদনা দেয়া হলেও টানা বড় দরপতন দেখা দিয়েছে। মূলত কোম্পানির রিজার্ভ ও বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর আরোপ করায় শেয়ারবাজারে এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

তরা বলছেন, রিজার্ভ ও বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর সংক্রান্ত যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে। রিজার্ভের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব করায় কোম্পানির সম্প্রসারণে অসুবিধা হবে। আবার রিজার্ভ ভাঙার কারণে ভালো কোম্পানির মৌলভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। সুতরাং রিজার্ভের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এছাড়া বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর আরোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাও সঠিক হয়নি। যে কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

তাদের মতে, বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর আরোপের কোনো দরকার ছিল না। সম্প্রতি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণ, সুষমকরণ, আধুনিকীকরণ, পুনর্গঠন ও বিস্তার এবং কোম্পানির গুণগতমানের উন্নয়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া বোনাস শেয়ার ঘোষণা করতে পারবে না মর্মে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বোনাস লভ্যাংশ নিরুৎসাহিতের জন্য তা যথেষ্ট ছিল।

তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বোনাস লভ্যাংশ কমিয়ে নগদ লভ্যাংশ দেয়া উৎসাহিত করতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করলে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা শেয়ারে বিনিয়োগ করে ক্যাশ ডিভিডেন্ড আশা করে। কিন্তু কোম্পানিগুলো ক্যাশ ডিভিডেন্ড না দিয়ে স্টক দিচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন; যার প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারে। তাই কোম্পানিকে স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান না করে ক্যাশ ডিভিডেন্ড প্রদানে উৎসাহিতের জন্য কোম্পানির স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ কর প্রদানের প্রস্তাব করছি।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠান শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড না দিয়ে রিটেইনড আর্নিংস বা বিভিন্ন ধরনের রিজার্ভ হিসেবে রেখে দেয়ার প্রবণতা দেখায়। এতে বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন, যার প্রভাব বাজারে পড়ে। কোনো কোম্পানির আয় বছরে রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ ইত্যাদির সমষ্টি যদি পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হয় তাহলে যতটুকু বেশি হবে তার ওপর কোম্পানিকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।’

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১৭ কোম্পানির মধ্যে ২০৯টির রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভের পরিমাণ পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ রিজার্ভের ওপর কর আরোপের বিষয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ২০৯টি কোম্পানিকে রিজার্ভের জন্য কর দিতে হবে।

কোম্পানিগুলোর মোট পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৫১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। মোট রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের পরিমাণ ৯৭ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। মোট পরিশোধিত মূলধনের অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ হচ্ছে ২৫ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের অতিরিক্ত মোট অর্থের পরিমাণ ৭১ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ শতাংশ হারে কোম্পানিগুলোকে কর দিতে হবে ১০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা।

কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৬২ কোটি টাকা কর দিতে হবে সরকারি কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনকে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেডকে দিতে হবে ৭২২ কোটি টাকা। এছাড়া স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসকে ৬৬৫ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংককে ৩৯৭ কোটি টাকা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোকে ৩৩৩ কোটি টাকা, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) ২৮৭ কোটি টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে ২৭৮ কোটি টাকা, যমুনা অয়েলকে ২৭৫ কোটি টাকা এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে ২৩৫ কোটি টাকা কর দিতে হবে।

মোটা অঙ্কের করের আওতায় পড়া অন্য কোম্পানির মধ্যে- ইউনিক হোটেলকে ২৩৩ কোটি, রেনাটাকে ২১৪ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংককে ১৯৩ কোটি, পূবালী ব্যাংককে ১৭৬ কোটি ও ইস্টার্ন ব্যাংককে ১৬৭ কোটি, পদ্মা অয়েলকে ১৬৪ কোটি, মেঘনা পেট্রোলিয়ামকে ১৫৯ কোটি, সামিট পাওয়ারকে ১৫৪ কোটি, সিটি ব্যাংককে ১৫২ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংককে ১৫০ কোটি, ডেসকোকে ১৪৯ কোটি, এসিআই লিমিটেডকে ১৪৬ কোটি, বিএসআরএম লিমিটেডকে ১৪৪ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে ১৪৪ কোটি, একমি ল্যাবরেটরিজকে ১৪০ কোটি, প্রাইম ব্যাংককে ১২১ কোটি, উত্তরা ব্যাংককে ১১৮ কোটি, বিএসআরএম স্টিলকে ১০৭ কোটি, ইউনাইটেড পাওয়ারকে ১০৫ কোটি এবং আইডিএলসি ফিন্যান্সকে ১০০ কোটি টাকা কর দিতে হবে।

গত ১৩ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে রিজার্ভ ও বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর আরোপের এ প্রস্তাবের পর ১৬ জুন, রোববার প্রধান শেয়ারবাজর ঢাক স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ৪৩ পয়েন্ট পড়ে যায়। সোমবার সূচকটি পড়ে ৫৫ পয়েন্ট। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেটের পর দুই কার্যদিবসে ডিএসই প্রধান মূল্য সূচক হারিয়েছে ৯৮ পয়েন্ট।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, রিজার্ভ ও বোনাস লভ্যাংশের ওপর ট্যাক্স বসানো বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে নেননি। ফলে বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য দেয়া প্রণোদনাগুলো বাস্তবে উল্টো হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, রিজার্ভের ওপর ট্যাক্স বসানোয় কোম্পানিগুলো সম্প্রসারণ করতে পারবে না। এতে সরকারও ট্যাক্স কম পাবে। আবার ট্যাক্সের কারণে রিজার্ভ ভাঙলে কোম্পানি দুর্বল হয়ে পড়বে। আমার কাছে মনে হয়, এগুলোর (রিজার্ভ ও বোনাস শেয়ারের ওপর ট্যাক্স আরোপ) ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, বোনাস লভ্যাংশের ওপর ট্যাক্স বসানোর কারণে ভালো কোম্পানি ঘাবড়ে যাবে। ফলে তারাও বোনাস লভ্যাংশ দেবে না। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ঢালাওভাবে বোনাস লভ্যাংশের ওপর ট্যাক্স বসানো উচিত হয়নি।

‘দুর্বল কোম্পানির বোনাস লভ্যাংশ ঠেকানোর জন্য কিছুদিন আগে বিএসইসি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটাই যথেষ্ট ছিল।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন এ প্রসঙ্গে বলেন, রিজার্ভের ওপর ট্যাক্স আরোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, আমরা মনে করি বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা সরকারের সর্বোচ্চ মহলের কাছে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি করব।

‘বিএসইসির সঙ্গে কথা বলেছি, তারাও উদ্বিগ্ন। আমরা সবাই মিলে অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব রাখব, বিষয়টির সমাধান হবে। বাজেটে বিষয়টি যেভাবে উপস্থাপন হয়েছে তা ভুল হয়েছে।’

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ‘রিজার্ভের ওপর ট্যাক্স আরোপ করলে ভালো কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের ধারণা, এটা ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে। ট্যাক্স দেয়ার পরই কোম্পানির অর্থ রিজার্ভে নেয়া হয়। সুতরাং আবার ট্যাক্স দিলে দ্বৈত ট্যাক্স হয়ে যাবে।’ এছাড়া কোনো কোম্পানির রিজার্ভ ক্যাশ ফর্মে নেই। তাহলে ট্যাক্স কীভাবে দেবে- প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এদিকে গতকাল সোমবার স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিএসইসি চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন জানান, রিজার্ভের ওপর ট্যাক্সের বিষয়টি প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়। এটা পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে আলোচনা করব। এছাড়া বিষয়টা সমাধানের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাজ করবে। তাই বাজেটে রিজার্ভের ওপর ট্যাক্স প্রস্তাব নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।

Bootstrap Image Preview