পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের যে অভিযোগ তুলেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে, তা সম্পূর্ণ বানোয়াট বলে গতকালও দাবি করেছেন সাময়িক বরখাস্তের মুখে পড়া এ কর্মকর্তা।
ঘুষ গ্রহণের কথোপকথনের যে অডিও রেকর্ড তুলে ধরেছেন ডিআইজি মিজান, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে এর সত্যতা প্রমাণের দাবি করেছেন এনামুল বাছির। অন্যদিকে ডিআইজি মিজানুর রহমানও তার অবস্থানে অনড়। দুদক কর্মকর্তা বাছির পুলিশ কর্মকর্তা মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনবিষয়ক অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকালে তার কাছ থেকে চাপ দিয়ে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন এবং ঘুষ দাবির সব অডিও রেকর্ড তার হাতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে দুদকের ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তার মধ্যে ঘুষ লেনদেনের যে অভিযোগ উঠেছে, দ্রুত এর তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একই সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তার এমন দুর্নীতির দায় দুদক কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
এনামুল বাছির গতকাল মঙ্গলবার দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এটা (ঘুষ হিসেবে ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ) সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি অভিযোগ। আপনারা সব এক্সপার্ট নিয়ে এটা প্রমাণ করুন। তিনি (ডিআইজি মিজান) প্রমাণ করুক। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ যে মিথ্যা, এর পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ রয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে এনামুল বাছির বলেন, মিথ্যা জিনিসের আবার কোনো প্রমাণ থাকে নাকি? তিনি বলেন, ওনার পক্ষে (মিজান) তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করায় আমার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের বানোয়াট অভিযোগ এনে ফাঁসানো হয়েছে।
একই দিন বেইলি রোডের নিজ বাসায় ডিআইজি মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, দুদক পরিচালক যে ঘুষ নিয়েছেন, আমার কাছে এর সব রেকর্ড আছে। কমিশন থেকে ডাকা হলে সব তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করব। তিনি বলেন, দুদক কমিটি করে অডিওটির সত্যতা যাচাই করুক। এই ভোকালটা (কণ্ঠস্বর) উনার (এনামুল বাছিরের) কিনা তা দেখুক। তা হলেই তো বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এটা অত্যন্ত সহজ বিষয়। নিজেকে সেভ করার জন্য এনামুল বাছিরের সঙ্গে তার কথোপকথন রেকর্ড করেছেন এবং এখন তুলে ধরেছেন বলে জানিয়েছেন ডিআইজি মিজান।
মিজানুর রহমান আরও বলেন, তদন্ত চলাকালে দুদক কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। বারবার দেখা করতে বলেন। আমি দেখা করলাম। এর পর যখন দেখলাম, এই লোকটা নিজেই দুর্নীতিবাজ, তখন ভাবলাম, এটা প্রমাণ করতেই হবে। আমি তাই এটি প্রমাণে ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়েছি। আমার স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। এসব অর্থের উৎসের সব তথ্য আমার কাছে আছে। আমি যথাসময়ে অনুসন্ধান কমিটিকে প্রমাণ দেব।
পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত এ কর্মকর্তা বলেন, আমি দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে অন্যায় কিছু চাইছি না। আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচার চাচ্ছি। উনারা যদি সেটা দিতে ব্যর্থ হন, তা হলে আমাকে আইনি আশ্রয় নিতে হবে। আমি আশা করব, তদন্ত কর্মকর্তারা কোনো রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে নয়, স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে আমার প্রতি ন্যায়বিচার করবেন।
নারী কেলেঙ্কারিসহ অবৈধভাবে অঢেল সম্পদ গড়ার অভিযোগে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছিলেন দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। অনুসন্ধানকালে তিনি কয়েক দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ ডিআইজি মিজানুরের। বেসরকারি একটি টেলিভিশনে সেই অডিও ফাঁসও করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির এবং পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের মধ্যে ঘুষ লেনদেনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা দ্রুত তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একই সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তার এমন দুর্নীতির দায় দুদক কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এমন মন্তব্য করে টিআইবি। এতে বলা হয়, তদন্ত কর্মকর্তার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। দুদক এ দায় এড়াতে পারে না। অন্যদিকে ঘুষ লেনদেনে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার সব অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দায়ও পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি দুদকের। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উভয়কেই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের ক্ষয়িষ্ণু আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে রীতিমতো শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত করতে না পারলে দুদকের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হবে না। একই সঙ্গে, দুর্নীতিরও আরও ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষায়িত কর্তৃপক্ষের ওপর দেশের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ তদন্ত শেষ করতে হবে; কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না’-দুদকের এমন অবস্থান আমাদের শুধু হতাশই করেনি বরং আমরা বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত বোধ করছি। দুদক নিজেই যদি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তা হলে তাদের কার্যক্রমের ওপর জনগণের আস্থা থাকবে কী করে?
অন্যদিকে ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ’ থেকে অব্যাহতি পেতে পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান ঘুষ দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করার পরও তার স্বপদে বহাল থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
ড. জামান বলেন, ঘুষ লেনদেনে জড়িত দুপক্ষই সমানভাবে দায়ী। বিশেষ করে যখন কোনো ব্যক্তি দুর্নীতির অভিযোগ থেকে পার পেতে ঘুষ দেন, তখন তার অপরাধের মাত্রা আরও গুরুতর হয়। পুলিশ প্রশাসন এখনো কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। তারা তদন্ত করে দেখার কথা বললেও সেটা কবে শুরু বা শেষ হবে তা আমরা জানি না।