Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ভূমধ্যসাগর থেকে ফিরে এলো আরও এক বাংলাদেশি

হাসান আহমদ, ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ২৪ মে ২০১৯, ০৮:৫৭ PM
আপডেট: ২৪ মে ২০১৯, ০৮:৫৭ PM

bdmorning Image Preview


বিদেশে উচ্চ বেতনের আশা দিয়ে এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকদের টোপে ফেলে অবৈধপথে বিদেশে নিয়ে যায় মানবপাচারকারী চক্র। একাজে স্থানীয় দালালরা প্রথমে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে বেকার যুবকদের টার্গেট করে। পরে উচ্চ বেতনের প্রলোভন ও ভালো গেইমের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ইউরোপের দেশগুলোতে পাঠানোর কথা বলে। বেকার যুবকরা ইউরোপে যাওয়ার কথা শুনেই রাজি হয়ে যায়।

পরে দালালের কথামতো টাকা পরিশোধের পর শুরু হয় অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রা। এসব নিয়ে কথা হয় ছাতক উপজেলার নুরুল্লাপুর গ্রামের সদ্য লিবিয়া ফেরত যুবক মোঃ শরীফ উদ্দিনের সঙ্গে।

শরীফ জানায়, সেসহ তার আরও দুই বন্ধু ২০১৮ সালের ২৫ মে দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশ যায়। এজন্য কোন প্রমাণপত্র ছাড়াই দালালের হাতে প্রথমে তুলে দেয়া হয় নগদ সাড়ে ৫ লাখ টাকা। চেকের মাধ্যমে দালালরা টাকা গ্রহণ করেন না। এমনকি কোন চুক্তিনামা বা স্বাক্ষীও থাকে না। টাকা নেয়ার সময় দালালরা বলে ইতালি পৌঁছানোর পর সবাইকে জানাতে পারবে টাকার কথা।

ওইদিন রাতে শরীফ ও তার বন্ধুরা ঢাকার উদ্দেশ্যে গ্রামের বাড়ি ছাড়ে। ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক  বিমানবন্দর দিয়ে প্রথমে তারা দুবাই যান। বিমানে ওঠার পরপরই দুবাইয়ের ভিজিট ভিসা ছিড়ে ফেলেন সবাই। বিমানে থাকা অবস্থায় লিবিয়া যাওয়ার পারমিট বের করে হাতে নেন।

পরে দুবাই থেকে বিমানে চড়ে যান মিশর, মিশর থেকে আলেকজান্দ্রা হয়ে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে। মিশরে যাওয়ার পর দালাল তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। সেখানে একটি রুমে গাদাগাদি করে তাদেরকে ১৫ দিন রাখা হয়।

এসময় লিবিয়ায় অবস্থানকারী দালাল জানায়, লিবিয়ার উপকূলীয় শহর জিলটনে যেতে হলে আবারও টাকা দিতে হবে।পরে বাড়িতে যোগাযোগ করে পরিবার পরিজনকে বলে আরও টাকা দিতে বলে। চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় লিবিয়ার দালাল। টাকা পাঠানোর পর তার স্থান হয় লিবিয়ার জিলটন শহরে। সেখানে আবারও একটি ঘরের মধ্যে তাদেরকে নজরবন্দী করে রাখা হয় ৫/৬ মাস। এসময় তাদেরকে প্রতিদিন নাম মাত্র খাবার দাবার দেয়া হতো।

অন্য জায়গায় কাজ করার কথা বললে তাদেরকে মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দেয়ার ভয় দেখায় বাঙ্গালি দালাল। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়। পরে আসে স্বপ্নের শহর ইতালি যাওয়ায় গেইম খেলানোর দিন। যেদিন গেইম হবে সেদিন তাদেরকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। যা লিবিয়ার উপকূলের কাছাকাছি কোন এলাকা। সেখান থেকে তাদেরকে তোলা হয় নৌকায়।

শরীফ জানায়, প্রথম গেইমের নৌকায় ১২৫ জন ইতালি যাওয়ার যাত্রী ছিল। যাত্রীদের মধ্যে  ৪৫ জন বাংলাদেশি  ছিলেন। প্লাস্টিকের বোটে চড়ে তারা সাগড় পারি দেয়ার চেষ্টা করে। এসময় তাদের বহনকারী নৌকাটি ২৩ ঘন্টা চলার পর লিক হয়ে যায়। লিক হওয়ার কারণে সাগড়ে ৩  থেকে ৪ ঘন্টা ভেসে থাকে। এসময় তার চোখের সামনে ৪/৫ যাত্রী সাগড়ে ডুবে মারা যায়।

খবর পেয়ে লিবিয়ার উপকূল রক্ষী বাহিনী তাদের উদ্ধার করে আবারও লিবিয়ায় নিয়ে আসে জেলে পুরে দেয়। পরে জনপ্রতি লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পান। ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর তারা আবার দ্বিতীয় গেইমে নাম লিখান। এজন্য দেশ থেকে আবারও টাকা নিয়ে এসে দালালের হাতে তুলে দেয়া হয়। গেইমের দিন সকাল ১০ টার দিকে তাদেরকে আবারও প্লাস্টিকের নৌকায় তোলা হয়।

তাদের বহনকারী নৌকাটি ছুটে চলে মাঝ সাগড়ের দিকে। সেখানে কথা ছিলো সাগর দিয়ে ইতালির উপকূলে যে জাহাজ যাবে সে সব জাহাজে তাদেরকে তুলে দেয়া হবে। পরে আবার ছোট নৌকায় চড়ে তারা ইতালির উপকূল এলাকায় যাবে।জিলটন থেকে ইতালি জাহাজে যেতে সময় লাগে ৩২ ঘন্টা। বোটে যেতে সময় লাগে ৬০ থেকে ৭২ ঘন্টা। ইতালি যেতে হলে মালটা সাগর পারি দিয়ে যেতে হয়। ২য় গেইমের সময় বোটে ৯৯ জন যাত্রী ছিলো কিন্তু বোটের ধারণ ক্ষমতা ছিলো মাত্র ত্রিশজন।

দ্বিতীয় বোটটি সাগড়ে মাত্র ৭ ঘন্টা চলার পর লিক হয়ে যায়। এসব যাত্রীর মধ্যে সিলেটের ৮ জন যাত্রী ছিলো। যাদের গড় বয়স ২২ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। অচল বোটটি সাগরের বাতাসে মাল্টা হয়ে ইতালির দিকে যায়। বোটটি এসময় ইতালির ২'শ কিলোমিটার জলসীমার ভেতরে ছিলো। সেখানে বোটে থাকা দালালরা পানামা শিপের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ইতালির সিসিলি দ্বীপে নামিয়ে দেয়ার কথা বলে।

এসময় ইতালির উপকূল রক্ষীরা জানায়, তাদের উদ্ধার করতে ৪ ঘন্টা সময় লাগবে ও মাল্টার উপকূল রক্ষীরা জানায়,  ৮ ঘন্টা সময় লাগবে। আবারও ধরা পড়ে যান লিবিয়ার উপকূল রক্ষী বাহিনীর হাতে। তারা তাদেরকে মিস্রতা কারানিং জেলে নিয়ে যায়। জেলে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য পানির পাইপ দিয়ে মারধর করতো।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার সহযোগিতায় সে ছাতকের গ্রামের বাড়ি নুরুল্লাপুরে আসে। তার কথা ভেবে ভেবে এক বৎসরের মধ্যে তার বাবা মারা যান। ঋণে জর্জরিত তাদের পরিবার। দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে সে কারণ দালালের মোবাইল সারাক্ষণ বন্ধ থাকে। তবে দেশের সকল যুবকদের সে বলতে চায় তার মতো অবৈধ পথে আর কেউ যেন বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন না দেখেন।

 

Bootstrap Image Preview