Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘দেশে দিনমজুরি করে খাব তবুও আর বিদেশের নাম নেব না’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৪ মে ২০১৯, ১২:৫৫ PM
আপডেট: ২৪ মে ২০১৯, ১২:৫৫ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গত বছরের ১০ রমজান বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলাম। এক বছর পর আবার রমজান মাসেই বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু এবার সেই স্বপ্নের সমাধি দিয়ে ফিরেছি বলে জানিয়েছেন অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির কবলে পড়া সিলেট শহরতলির ঘোপাল এলাকার রুবেল আহমদ।

রুবেল আহমদ কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, প্লাস্টিকের ছোট নৌকায় ১৫ জন বাংলাদেশিসহ ৫৭ জন অভিবাসন প্রত্যাশী লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। নৌকায় জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়ায় টানা ২ দিন ৩ রাত ভূমধ্যসাগরে তারা ভেসে ছিলেন। পরে অবশ্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াই তিউনিশিয়ার কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে।

তিনি জানান, সাগরে ভাসতে থাকা নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়ারাই গত মঙ্গলবার দেশে ফেরেন। তবে তারা দেশে ফিরেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের গ্যাড়াকলে পড়েন। প্রায় ১৮ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত বুধবার সিলেটের ১১ যুবক বাড়ি ফেরেন।

রুবেল বলেন, গত ৯ মে ১৫ জন বাংলাদেশিসহ ৫৭ জনের একটি টিম নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্লাস্টিকের একটি ছোট নৌকা। মাছের জাহাজে ইতালি পৌঁছানোর কথা থাকলেও আমাদের জোর করে তোলা হয় ছোট্ট নৌকাটিতে। ওই দিন ইফতারের পর আমাদের ৫৭ জনকে নেয়া হয় সাগরপাড়ে। সেখানে নিয়ে কোমর পানির মধ্য দিয়ে সাগরের তীর দিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা হাঁটানোর পর নিয়ে যাওয়া হয় প্লাস্টিকের নৌকায়। আমাদের মধ্যে অনেকেই যেতে অপারগতা প্রকাশ করলে দালালরা গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়। পরে প্রাণ ভয়ে আমরা নৌকায় উঠে যাই।

যাত্রার একদিন পরই আমাদের নৌকার জ্বালানী শেষ হয়ে যায়। এরই মধ্যে যেসব শুকনো খাবার দেয়া হয়েছিল তা প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। এছাড়া কিছু কেক ছিল তা ইন্দোনেশিয়া ও সুদানের কয়েকজন অভিবাসন প্রত্যাশী জোর করে কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে। এ অবস্থায় আমরা বিপদে পড়ে যাই।

জ্বালানী শেষ হওয়ার প্রথম রাতে যেদিন আমরা সাগরে ভাসছিলাম সেদিন একটি তেলের জাহাজ আমাদের লাইট দিয়ে অনেক পথ দেখিয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের কাছে হেল্প চাইলে কোনো সাড়া দেয়নি। যখন সাগরের ঢেউ আসে তখন মনে হয় এই বুঝি শেষ। সঙ্গে সঙ্গে কালিমা পড়তে থাকি। আর দিনের বেলায় যখন সাগরে ভাসছিলাম তখন আকাশ দিয়ে একটি বিমান গেলে আমরা হেল্প হেল্প বলে চিৎকার শুরু করতাম। মনে হতো এই বুঝি আমাদের উদ্ধার করতে এসেছে। কিন্তু বিমানগুলো একটিবারও আমাদের দিকে ফিরে থাকায়নি। তিনদিন পর তিউনিশিয়ার জেলেরা আমাদের উদ্ধার করে সেদেশের কোস্ট গার্ডের কাছে হস্তান্তর করে। সেখানে আমাদের একটি কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। পরে আইএমএফের মাধ্যমে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়।

রুবেল বলেন, আমার কোনো শত্রুকেও কোনো দিন অবৈধপথে ইতালি যেতে বলব না। আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমরা কোনোমতে প্রাণে বেঁচে এসেছি যা কল্পনাও করতে পারিনি। সাগরের প্রতিটি ঢেউ আমাদের মৃত্যুর দূত হয়ে এসেছিল। কিন্তু সকলের দোয়ায় প্রাণে রক্ষা পেয়েছি।

তিনি জানান, ২০১৮ সালের জুন মাসে ১০ রমজান সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কাঠলীপাড়া গ্রামের চমক আলীর ছেলে আদম বেপারি রফিকুল ইসলাম রফিকের মাধ্যমে রুবেলকে লিবিয়া পাঠানো হয়। রফিক লিবিয়ায় থাকা ছেলে পারভেজের মাধ্যমে ইতালী পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

লিবিয়ার পৌঁছার আগে সাড়ে ৫ লাখ টাকা নেয় রফিক। এরপর গত ৯ মে লিবিয়া থেকে ইতালী পাঠানোর আগে তাদের কাছ থেকে আরো সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেয় তারা। ওই টাকাগুলো নিজের বসতঘরের পাশের ৪ শতক জায়গা বিক্রি করে দেয়া হয়। সবমিলিয়ে ৯ লাখ টাকা দালাল রফিক ও তার ছেলে পারভেজের কাছ দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, ১৫ জন বাংলাদেশিসহ ৫৭ জন অভিবাসন প্রত্যাশী গত ৯ মে লিবিয়া থেকে ইতালির পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন। জ্বালানী শেষ হওয়ায় দু’দিন সাগরে ভাসার পর ১১ মে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া তিউনিশিয়ার উপকূলে পৌঁছান তারা। সেখানে তিউনিশিয়ার কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে। ওই নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া ১৫ বাংলাদেশিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সহায়তায় গত মঙ্গলবার দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পরে বুধবার রাত আড়াইটার দিকে সিলেটে এসে পৌঁছান তারা।

গণমাধ্যমে এই দলটিকে সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া যাত্রী বলে প্রচার করা হলেও লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ মে ডুবে যাওয়া নৌকায় থাকা ১৪ জন জীবিত বাংলাদেশি এখনো তিউনিশিয়ার রেড ক্রিসেন্টের আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন। ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে এই দলটির (দেশে ফেরা ১৫ জন) খোঁজ পায় দূতাবাস। পরে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মাধ্যমে তাদের একটি টার্কিশ বিমানে করে ঢাকায় পাঠানো হয়।

রুবেলের দেয়া তথ্যমতে, দেশে ফেরা ১৫ জনের মধ্যে সিলেটের ১১ জন ও বাকিরা ঢাকার। সিলেটের ১১ জনের মধ্যে রয়েছেন, বিশ্বনাথ পালরচক এলাকার মাছুম মিয়া, লালাবাজার এলাকার সাইদুল ইসলাম জাবের, সুনামগঞ্জের গোবিন্দগঞ্জ বালিয়াকান্দি এলাকার মতিন মিয়া, গোবিন্দগঞ্জ তাজপুর রাজবাড়ি এলাকার হান্নান মিয়া, একই এলাকার ইকবাল হোসেন, মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার বেড়ফুরি গ্রামের শাহেদ, সিলেটের বিয়ানীবাজার এলাকার শাহেদ আহমদ খান, হবিগঞ্জের সোহেল আহমদ, রাশেদ ও সজিব।

Bootstrap Image Preview