Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

নুসরাতের পর রাজশাহীতে বর্ষা: সেই ওসি প্রত্যাহার

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২১ মে ২০১৯, ০৮:২৮ PM
আপডেট: ২১ মে ২০১৯, ০৮:৩০ PM

bdmorning Image Preview


ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতের পর রাজশাহীতে ঘটে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। 'আত্মহত্যা' করে সুমাইয়া আক্তার বর্ষা (১৪) নামে নবম শ্রেণির ছাত্রী। এ ঘটনার পেছনেও ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসির মতো রাজশাহীর মোহনপুর থানার ওসির বিরুদ্ধে গাফেলতির খবর রয়েছে। ফলপ্রসূতেই আত্মহত্যা করে বর্ষা। মোহনপুর থানার ওসি আবুল হোসেনের গাফলতির সেই খবরই উঠে এসেছে।

বর্ষার আত্মহত্যার ঘটনায় মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) থানা পুলিশের গাফিলতির বিষয়টি দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ। ইতোমধ্যে মোহনপুর থানার ওসি আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার ক‌রে পু‌লিশ লাইন‌সে সংযুক্ত করা হয়েছে।

সোমবার (২০ মে) দিবাগত রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সদর দফতরের এআই‌জি (মি‌ডিয়া অ্যান্ড পিআর) সোহেল রানা।

তিনি বলেন, সুমাইয়ার আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবার অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি মোহনপুর থানার ওসিসহ থানা পুলিশের কোনো গাফিলতি আছে কি না তা খতিয়ে দেখবে।

জেলা পুলিশের ডিএসবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মতিউর রহমান মোল্লার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই ঘটনায় সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত তদ‌ন্তের স্বা‌র্থে ওসিকে প্রত্যাহার ক‌রে পু‌লিশ লাইন‌সে সংযুক্ত করা হ‌য়ে‌ছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হ‌বে বলেও জানান এআইজি সোহেল রানা।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১৬ মে) সন্ধ্যায় রাজশাহীর মোহনপুরে নিজ বাড়ির কক্ষ থেকে সুমাইয়ার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

আত্মহত্যার আগে চিরকুটে সুমাইয়া লিখে, ‘প্রিয় মা-বাবা, প্রথমেই তোমাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি, অনেক আদর অনেক ভালোবাসা। কিন্তু একটা মেয়ের কাছে তার মান-সম্মানটাই সবচেয়ে বড়। আমি আমার লজ্জার কথা সবাইকে বলতে বলতে নিজের কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছি। প্রতিদিন পরপুরুষের কাছে এসব বলতে বলতে। আমি আর পারছি না। অপরাধীকে শাস্তি দিলেই তো আমার মান-সম্মান ফেরত পাবো না। আমাকে ক্ষমা করো।’

নিহত বর্ষার পরিবারের সদস্যরা এই প্রতিনিধিকে জানান, অপহরণের পর আসামির স্বজনের হুমকি আর অপমানে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার স্কুলছাত্রী সুমাইয়া আকতার বর্ষা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

আত্মহত্যার আগেই পুলিশের কাছে অপহরণের মামলা করতেও যান তারা বাবা। তবে মামলা না নিয়ে উল্টো তাকে পিটিয়ে দাঁত ভেঙে দিতে চান মোহনপুর থানার ওসি আবুল হোসেন। শুধু তাই নয়, পরপর চারদিন থানায় গভীর রাত পর্যন্ত আটকে রেখে তাকে হয়রানি করারও অভিযোগ রয়েছে। শনিবার (১৮ মে) সকালে মোহনপুর উপজেলা সদরে বর্ষার বাড়িতে গেলে এসব তথ্য জানান পরিবারের সদস্যরা। তারা বলেন, সঠিক সময়ে পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নিলে বর্ষাকে হয়তো আত্মহনন থেকে বাঁচানো যেত।

বর্ষার আত্মহত্যার পর তার বোন জানান, বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষা স্কাউট দলের সেকেন্ড ক্যাপ্টেন ছিল। স্কুলে যাতায়াতের সময় প্রায় ৬ মাস ধরে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল পাশের বাড়ির আনিস উদ্দিনের ছেলে মুকুল। তার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে বিষয়টি বর্ষা বাড়িতে জানিয়েছিল। তারা উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যানকেও এ ঘটনা জানিয়েছিলেন। তবে তারা ভাবতেই পারেননি, বর্ষাকে অপহরণ করার মতো ঘটনা ঘটাবে মুকুল।

তিনি আরও জানান, গত ২৩ এপ্রিল প্রাইভেট পড়তে যেতে চায়নি বর্ষা। তার সহপাঠী প্রতিবেশী সোনিয়া অনেকটা জোর করেই সেদিন তাকে নিয়ে যায়। এরপর সোনিয়া বাড়ি ফিরলেও বর্ষা আসেনি। বিকেলে তারা খবর পান, বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে খানপুর বাগবাজার এলাকায় অচেতন অবস্থায় বর্ষা পড়ে আছে। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে আনা হয় উপজেলা পরিষদের গেটে।

ওইদিন সন্ধ্যায় তার বাবা থানায় অপহরণের মামলা করতে যান। তবে ওসি আবুল হোসেন নানা অজুহাতে রাত ১২টা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখেন। পরে বর্ষার অবস্থার অবনতি হলে রাত সাড়ে ১২টায় পুলিশের গাড়িতে করেই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওইদিন রাতেই পুলিশ অভিযুক্ত মুকুলকে গ্রেফতার করলেও সকালে ছেড়ে দেয়। এরপর টানা চার দিন মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি।

বর্ষার আত্মহত্যার পর বাবা আব্দুল মান্নান চাঁদ বলেন, আমরা এসপির কাছে যাব। বিষয়টি জানতে পেরে প্রতিদিন থানায় ডেকে আটকে রাখা হচ্ছিল আমাকে। পরে একদিন ওসিকে বলি, যদি মামলা না নেন, তো বলে দেন। হয়রানি কেন করছেন? একথা বলতেই ওসি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, পিটিয়ে দাঁত-মুখ ভেঙে দেব।

আব্দুল মান্নান বলেন, এরপর মোহনপুরের সাবেক ইউএনও (বর্তমানে এডিসি) আলমগীর কবীরকে বিষয়টি ফোনে জানাই। তিনি জেলা পুলিশ সুপারকে জানান। পুলিশ সুপার বর্ষাকে নিয়ে যেতে বললে তাকে সব খুলে বলি। এরপর ওসি থানায় মামলা নেন। তবে তিনি ধর্ষণের অভিযোগ বাদ দেন। ওসি বলেন, মেডিকেল রিপোর্ট ছাড়া ধর্ষণের মামলা নেওয়া যাবে না।

সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা সদরের আব্দুল মান্নান চাদের মেয়ে ৯ম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আকতার বর্ষা (১৪) রাস্তায় যাওয়া-আসার সময় পাশের বাড়ির আনিস উদ্দিনের ছেলে মুকুল (১৮) প্রায় তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গত ২৩ এপ্রিল প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় প্রতিবেশী শরিফুল ইসলামের মেয়ে বান্ধবী (ক্লাসমেট) সোনিয়ার সহযোগিতায় স্কুলছাত্রী বর্ষাকে মুখে রুমাল চেপে অপহরণ করে।

পরে ওইদিন খানপুর বাগবাজার এলকার লোকজন অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন স্কুলছাত্রীর পরিবারকে খবর দিলে তারা উদ্ধার করে প্রথমে মোহনপুর উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করান। অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে হন্তান্তর করে। স্কুলছাত্রীর বাবা বাদি হয়ে মোহনপুর থানায় গ্রেফতারকৃত দুইজনের নাম উল্লেখ করে ২/৩ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে অপহরণ মামলা দায়ের করেন।

বর্ষার আত্মহত্যার পর মা ফরিদা বেগম বলেন, বর্ষা বাড়ি ফিরে তাদের জানায়, সহপাঠী সোনিয়া তাকে প্রাইভেট পড়ার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। পরে সে রুমাল দিয়ে তার নাক ধরে। এরপর বর্ষা অচেতন হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফিরে সে নিজেকে বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বাগবাজার এলাকায় দেখতে পায়। নিজের শরিরে থাকা জামার বদলে অন্য জামা দেখতে পায়। তার পাশে তখন অভিযুক্ত মুকুল ও দেলোয়ার নামের একজন ভ্যানচালক ছিল। তবে পুলিশ অপহরণ মামলায় দেলোয়ারকে আসামি করেনি। জামা বদল থাকায় ধারণা করা হচ্ছিল, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

ফরিদা বেগম আরও বলেন, ২৭ এপ্রিল মামলার পর মুকুলকে গ্রেফতার করা হলে শুরু হয় চরম গালাগাল ও হুমকি। আসামিরা বাড়ি এসে মেয়েদের এসিড নিক্ষেপের হুমকি দেয়। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। গত বৃহস্পতিবার গোসল করতে গেলে বর্ষাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেওয়া হয়। এতে অভিমানে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।

মোহনপুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সানজিদা রহমান রিক্তা বলেছিলেন, একটি মেয়ে মারা গেলেও আরও দুই মেয়ে নিয়ে চরম আতঙ্কে আছেন বর্ষার বাবা। তাদের নিরাপত্তা ও অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন তিনি।

ঘটনাটি নিয়ে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দীন বলেছিলেন, এ ঘটনায় জড়িত ও দায়িত্বে অবহেলাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

Bootstrap Image Preview