নওগাঁর রাণীনগরে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যেই নির্মাণাধীন ৩টি ব্রীজের খাম্বা’র ভারবহন সক্ষমতা পরীক্ষা (পাইল লোড টেষ্ট) ছাড়াই পাইল ক্যাপ, বেজ ঢালাইসহ ওয়াল নিমার্ণ কাজও প্রায় সম্পূর্ণ করা হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের বেলায় দায়সাড়া টুুকটাক কাজ করতে দেখা গেলেও রাতের আধারে চুপিসারে পুরোদমে চালিয়েছে সেতুর পাইলিং এর কাজ। পাইল লোড টেষ্ট না করে সেতু নির্মাণের ফলে ভবিষ্যতে পাইলের সাথে সাথে সেতুর বিভিন্ন অংশ ডেবে গিয়ে সেতু ভেঙ্গে পড়াসহ ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এলাকার সচেতন মহল। সেতু নির্মাণ সংক্রান্ত সব ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টসহ দরপত্রের ফটো কপি চাইলে নওগাঁর সড়ক ও জনপদের কর্তা ব্যক্তিদের অযুহাত আর তালবাহানার যেন অন্ত নেই।
স্থানীয় এক প্রকৌশলী আবু তারেক’র মতে, সেতু নির্মাণের শুরুতে নিদিষ্ট স্থানে মাটি শক্তি পরীক্ষা অর্থাৎ সেখানকার মাটি কতটুকু লোড নিতে সক্ষম সেটা পরীক্ষার পর পাইলের কাঠামো তৈরি করে পাইল (খাম্বা) নির্মাণ করা হয়। বড়-ছোট সেতু ভেদে পাইলিং কয়েক ধরণের হয়ে থাকে। সেই পাইলগুলোর ইন্টিগ্রেটি (খাম্বা’র অখন্ডতা) পরীক্ষা, পাইল লোড টেষ্টসহ (খাম্বা’র ভারবহন সক্ষমতা পরীক্ষা) বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।
পাইল লোড টেষ্ট বলতে, দরপত্র মোতাবেক সেতুর ডিজাইন লোডের দেড় গুণ বেশি ভারি বস্তু পাইলের উপর চেপে ভারবহন সক্ষমতা পরীক্ষা করাকে বুঝায়। এসময় ভারি বস্তু অথবা সিমেন্ট-বালির বস্তা, পিষ্টন, ডায়াল গেজ, প্রেসার গেজ, রেফারেন্স গেজ মেশিন সাধারণত ব্যবহার করা হয়। যার প্রস্তুতি নিতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। ওই ভারি বস্তুগুলো পাইলের উপর কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা থেকে ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত রাখতে হয়। পাইল ও মাটির ঘর্ষণের (ফ্রিক্শন) মাধ্যমে মাটির ভিতর লোড স্থানান্তর করে লোড বহনে সক্ষম কি না তা পরীক্ষা করা হয়।
এসব কার্য সম্পাদনের সময় যদি পাইলগুলো ১২ থেকে ২৫ মিলিমিটার ডেবে যায় তাহলে ওই পাইলের পাশে আরো একটি করে পাইল নির্মাণ করা যেতে পারে। আর যদি ২৫ মিলিমিটারের বেশি ডেবে যায় তাহলে পুনরায় নতুন করে পাইলের কাঠামো তৈরি করতে হবে। কোন ঠিকাদার যদি এই সব কার্য সম্পূর্ণ না করেই সেতু নির্মাণ করে তাহলে এই সেতুর উপর দিয়ে ভারি যানচলাচলে মারাত্মক ঝুকি থাকে। পাইল ডেবে যাওয়ার সাথে সাথে সেতুর উপরের বিভিন্ন অংশগুলোও ডেবে যায়, যার ফলে ব্যস্ততম সড়কের এই সেতু গুলো ধীরে ধীরে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।
তবে সেতু নির্মাণ কাজের তদারকি কর্মকর্তা নওগাঁর সড়ক ও জনপদের উপ-সহকারি প্রকৌশলী মিনহাজুর রহমান স্বপন দাবি করে বলেন, এখন আর ১০/১৫ দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়ে ২৪/৩৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় না। আধা ঘন্টায় অত্যাধুনিক মেশিন দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। রাজধানী ঢাকা থেকে লোকজন এসে নির্মাণাধীন সেতুগুলোর সব ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। সেই অত্যাধুনিক মেশিনটির নাম ও সেতু নির্মাণ সংক্রান্ত সব ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টসহ দরপত্র মোতাবেক তথ্য ও ফটো কপি চাইলে, 'অত্যাধুনিক মেশিন' এর নাম তিনি জানেন না ও তার কাছে এসব তথ্য থাকে না মর্মে সড়ক ও জনপদের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের পরামর্শ দেন তিনি।
সড়ক ও জনপদের এই কর্মকর্তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় ওই প্রকৌশলী সাংবাদিকদের জানান, নির্মাণাধীন ৩টি সেতুর দরপত্রে যদি পাইল লোড টেষ্ট করার কথা থাকে তাহলে অল্প খরচের মধ্যেই হয়ে যাবে। আর ‘অত্যাধুনিক মেশিন’ কি? তা আমার জানা নেই। তবে বড় বড় সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘অত্যাধুনিক’ হিসেবে পিডিএ টেষ্ট (খাম্বা’র গতীয় বিশ্লেষণ) করা হয়। কিন্তু পিডিএ টেষ্ট অনেক ব্যয় বহুল, তাছাড়া এই সব সেতুর পাইলের উপর পিডিএ টেষ্টের আয়োজন করা সম্ভব না। ভার নিতেই পারবে না।
আমার জানা মতে, দেশে হাতেগোনা কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে পিডিএ অর্থাৎ পাইল ডাইনামিক এ্যানালাইসিস করার সরঞ্জামাদি রয়েছে। তবে যাদের পিডিএ করার মেশিন বা সরঞ্জামাদি রয়েছে তারা অবশ্য অন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেয়। প্রতিটি সেতুর পাইল টেষ্ট’র জন্য সর্বনিন্ম ৩ লক্ষ থেকে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দেয়। কিন্তু এই ৩টি সেতুর লোড টেষ্ট করার জন্য নিজ খরচে একজন ঠিকাদার কেন অতিরিক্ত ৪/৫ লক্ষ টাকা খরচ করবে?
জানা গেছে, রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে আবাদপুকুর হয়ে কালীগঞ্জ সড়কে চলাচলরত যাত্রী-সাধারণ ও নির্বিঘ্নে সব ধরণের ভারি যানচলাচলের লক্ষ্যে ঝুকিপূর্ণ সেতু সংলগ্ন নতুন করে ৪টি সেতু ও ২৪টি কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। দরপত্র আহবানের পর এসব সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ কাজের যৌথ দায়িত্ব পেয়েছেন, নাটোর জেলার ঠিকাদার মীর হাবিবুর আলম, এমএ মিজান ও ইউনুস এ্যান্ড বাদ্রার্স নামক প্রতিষ্ঠান। ৪টি সেতুর নির্মাণ ব্যয় ২৮ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা। ৪টি সেতুর মধ্যে ৩টি সেতুর পাইলিং কাজ দিনের বেলায় দায়সাড়া টুুকটাক করতে দেখা গেলেও রাতের আধারে চুপিসারে অনিয়মের মধ্য দিয়ে পুরোদমে করেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার সাইফুল ইসলাম ও সেতু সংলগ্ন রাজাপুর গ্রামের আব্দুল মালেক, আব্দুল আজিজ, আব্দুর রহিমসহ অনেকই জানান, পাইল লোড টেষ্ট করতে আমরা দেখিনি। পাইল, ক্যাপ, ওয়ালসহ সেতু নির্মাণে কি ধরণের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে তাও জানা সম্ভব নয়। কারণ তারা তো দিনের বেলায় পাইলের কাজই করেনি। রাতের আধারে পুরোদমে নির্মাণ কাজ করেছে। সেই সময় তো রাত জেগে ওখানে থাকা সম্ভব নয়। আর তারা তো দরপত্রটা দেখাতে চায় না। আধুনিক মেশিন বা পুরাতন যেটা দিয়েই হোক পাইল লোড টেষ্ট যদি করতো তাহলে অন্তত বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দেখা যেত। কিন্তু তারা সেগুলো করেনি।
এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে তাদের দাবি, দরপত্র মোতাবেক নির্মাণ কাজ আমরা দেখে নিতে চাই। পাইল লোড টেষ্ট না করে সেতু নির্মাণের ফলে ভবিষ্যতে ছোট-বড় দূর্ঘটনা ঘটার আশংকাসহ সেতুর স্থায়ীত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।
এ ব্যাপারে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তদারকি প্রকৌশলী মো: মুনছুর আলী বলেন, নির্মাণাধীন সেতুগুলোতে কাষ্ট-ইন-সিটু পাইল করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার টেকনো ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এসে পাইল লোড টেষ্টসহ সব ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পূর্ণ করে গেছেন। অত্যাধুনিক মেশিন দিয়ে লোড টেষ্ট করা হয়েছে। তবে ওই মেশিনের নাম কি তা জানি না। এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ঢাকাতে গিয়ে ‘টেকনো’ অফিস থেকে জানতে পারবেন। অত্যাধুনিক মেশিন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিজ খরচে ভাড়া নিয়ে সকল কার্য সম্পাদন করেছেন।
এব্যাপারে নওগাঁর সড়ক ও জনপদের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল মুনছুর আহমেদ এর কাছে উপরোক্ত বিষয় সংক্রান্ত জানতে চাইলে তিনি রাগান্বিত হয়ে সাংবাদিককে বলেন, লোড টেষ্ট না হলে আপনার কি? সেতু ভেঙ্গে গেলে আপনার কি হবে? কার জেল জরিমানা হবে? আমার চাকরি যাবে? কিছুই হবে না! তবে সব দায়ভার আমাদের, কারণ সরকার সড়ক ও জনপদ বিভাগকে দ্বায়িত্ব দিয়েছেন। বিষয়গুলো আমরাই দেখবো! নির্মানাধীন ৩ টি সেতুর ডিজিটাল পদ্ধতিতে সব ধরণের টেষ্ট করা হয়েছে। কাজে কোন প্রকার অনিয়ম হচ্ছে না। তবে ‘অত্যাধুনিক মেশিন’ এর নাম তিনিও বলতে পারেননি।
নওগাঁর সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: হামিদুল হক বলেন, রাণীনগরে নির্মানাধীন সেতুগুলোর সব রকমের টেষ্ট সম্পূর্ণ করা হয়েছে। আমার দফতরের সুপারভিশন কর্মকর্তা সব সময় এসব কাজের দেখাশুনা করছেন। চলমান কাজে কোন প্রকারের অনিয়ম হচ্ছে না। সেখানে অনেক ভাল মানের কাজ করা হচ্ছে।