Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে গাড়িচালকের বেতন ৭৪ হাজার, রাঁধুনি-মালির ৬৪

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৮ মে ২০১৯, ০৬:০৩ PM
আপডেট: ১৮ মে ২০১৯, ০৬:০৩ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত গ্রিনসিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়েছে। যেখানে ৭৩ হাজার ৭০৮ টাকা, যা একজন সচিবের কাছাকাছি। বর্তমানে সচিবের বেতন ৭৮ হাজার টাকা। রাঁধুনি আর মালির বেতন ৬৩ হাজার ৭০৮ টাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গাড়ি চালক, রাঁধুনি আর মালির এই পরিমান বেতন ধরা হয়েছে।

এক লাখ ১৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার এ-সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ওঠার কথা রয়েছে। পাস হওয়ার পর ব্যয়ের দিক থেকে এটিই হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, যা পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় চার গুণ।

জানা গেছে, এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের বেতন ধরা হয়েছে চার লাখ ৯৬ হাজার টাকা। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। এজন্য আরও পাবেন দুই লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রকল্প পরিচালক বেতন পাবেন ছয় লাখ ৯৬ হাজার টাকা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সম্মানি এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সম্মানির ছয়গুণেরও বেশি পাবেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক। একইভাবে উপ-প্রকল্প পরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালকসহ অন্য সব পদেই অস্বাভাবিক বেতন-ভাতা ধরা হয়েছে। বেতন ছাড়াও আরো কয়েকটি খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরে চূড়ান্ত করা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ (মূল পর্যায়)।

প্রকল্পটির বিভিন্ন খাতের অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। ১২ খাতে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়ে সুস্পষ্ট জবাবও চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

ডিপিপি অনুযায়ী, ৩৬৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ও ভাতা হিসেবে ৬৯৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বেতন ৩৬ শতাংশ এবং ভাতা ধরা হয়েছে ৬৪ শতাংশ।
সরকারি বেতন কাঠামোর গ্রেড অনুসরণ না করে ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই প্রকল্প পরিচালকসহ ১৬টি পর্যায়ে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আর প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্প পরিচালক পাবেন ছয় লাখ ৯৬ হাজার টাকা বেতন, যা সচিবের বেতনের প্রায় ৯ গুণ। যদিও পরিচালককে গ্রেড-১ তথা সচিবের সমমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক পাবেন তিন লাখ ৬৩ হাজার টাকা। তিনি প্রকল্পের স্টেশন ডিরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এজন্য অতিরিক্ত এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পাবেন তিনি। এতে তার মোট বেতন দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, যা প্রধানমন্ত্রীর বেতনের প্রায় ৪ দশমিক ৭২ গুণ। প্রকল্পের রাশিয়া অফিসের পরিচালকের বেতন ধরা হয়েছে তিন লাখ ২১ হাজার টাকা করে।

প্রকল্পের সাত বিভাগের সাতজন প্রধানের বেতনেও তিন লাখ ২১ হাজার টাকা। কারিগরি ও প্রশাসনিক অন্যান্য পদের বেতনও অনেক বেশি ধরা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পদেও এসব ব্যক্তি কাজ করবেন। এজন্য তারা অতিরিক্ত বেতন-ভাতা পাবেন।

বেতনের বাইরে বার্ষিক সর্বোচ্চ তিন মাসের মূল বেতনের সমান চিকিৎসা ভাতা, মাসিক তিন থেকে ছয় হাজার টাকা যাতায়াত ভাড়া, মাসিক ১০ থেকে ১৫ হাজার সন্তানদের শিক্ষাভাতা, মূল বেতনের ৪০ শতাংশ হারে মাসিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তেজস্ক্রিয় ভাতা এবং ২০ শতাংশ হারে শিফট ভাতা ও বিদ্যুৎ বিল ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রকল্পটির কর্মকর্তা পর্যায়ে সর্বনিম্নে বেতন ধরা হয়েছে এক লাখ তিন হাজার টাকা। বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা প্রতি মাসে এ হারে বেতন পাবেন। এর বাইরে তিনি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ থেকে অতিরিক্ত ৪৫ হাজার টাকা বেতন পাবেন। অর্থাৎ তার মোট বেতনের পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এতে তার বেতন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতির চেয়েও বেশি পড়বে।

প্রকল্পটির গাড়িচালকের বেতন ৭৩ হাজার ৭০৮ টাকা, যা একজন সচিবের কাছাকাছি। বর্তমানে সচিবের বেতন ৭৮ হাজার টাকা। তবে প্রকল্পটির গাড়িচালকরা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বও পালন করতে পারবেন। এতে আরও ১৮ হাজার টাকা পাবেন গাড়িচালকরা।

এতে তাদের বেতন দাঁড়াবে ৯১ হাজার ৭০৮ টাকা। প্রকল্পটির সর্বনিম্ন বেতন রাঁধুনি বা মালির। প্রকল্প থেকে তিনি বেতন পাবেন ৬৩ হাজার ৭০৮ টাকা। আর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন করলে অতিরিক্ত পাবেন ১৬ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তার বেতন পড়বে ৭৯ হাজার ৭০৮ টাকা, যা সচিবের বেতনের চেয়েও বেশি।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (প্রাথমিক পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেন, পরিকল্পনা কমিশন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাবে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এতে সংস্থাটির নিজস্ব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। তবে প্রকল্পের কোনো খাতেই অযৌক্তিক ব্যয় ধরা হয়নি। আর কর্মকর্তাদের বেতন নিয়ে যে কথা বলা হয়েছে, তা সঠিক নয়। এখানে আকর্ষণীয় বেতন না দিলে কেউ চাকরি করতে আসবে না। সব দিক বিবেচনা করেই এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে সব প্রশ্নের জবাব কমিশনে তুলে ধরা হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, প্রকল্পটির বেতন-ভাড়া সরকারি স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন ও অনিয়ন্ত্রিত। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অন্যান্য ব্যয় নিয়েও এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাবতা যাচাই স্পষ্ট নয়, ইআইএ নিয়ে লুকোচুরি, স্পেন্ট ফুয়েল (অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয় জ্বালানি) ইস্যুর সমাধান হয়নি। এরই মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আগে প্রকল্পের ব্যয়সহ বিতর্কিত ইস্যুগুলো সমাধান করা দরকার। এর পর প্রকল্প অনুমোদন পর্যায়ে যাওয়া উচিত।

সূত্রমতে, সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ (মূল পর্যায়) প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। ৯ বছর মেয়াদি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা।

রাশিয়ান ফেডারেশনের স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট হিসেবে দেবে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। বাকি ২২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা দেওয়া হবে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এর মধ্যে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পের বেতন-ভাতায় ৭০০ কোটি টাকা, যানবাহন কেনায় ৬৫ কোটি টাকা, সরঞ্জাম কেনায় ২৯২ কোটি টাকা, কম্পিউটার ও সফটওয়্যারে ১১১ কোটি টাকা, টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামাদি সংগ্রহে ১৪০ কোটি টাকা, ভূমি অধিগ্রহণে তিন হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, পরামর্শক প্রশিক্ষণ ও সেবা খাতের দুই হাজার ৯৯২ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন বেশি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে হবে। এর বাইরে কোনো কারণ ছাড়াই অনুুদান ও থোক বরাদ্দ ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এসব ব্যয় প্রাক্কলনে অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে। এসবের ব্যাখ্যা দিতে হবে।

Bootstrap Image Preview