কিশোরগঞ্জে চলন্ত বাসে নার্স তানিয়াকে গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। আজ রোববার জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণধর্ষণের পর তানিয়ার মাথায় আঘাত করে ধর্ষকরা। এতে তার মাথার খুলি ফেটে যায়।
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান ময়নাতদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এই চাঞ্চল্যকর মামলার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে জমা দিয়েছি। তানিয়ার শরীরে ১০টি স্থানে একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাকে ধর্ষণ এবং হত্যার আলামত পাওয়া গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তানিয়ার মাথার খুলি দুইভাগ হয়ে গেছে এবং মাথার পেছনের দিকে দুটি হাড় ভেঙে গেছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
ধর্ষণে কতজন জড়িত ছিল জানতে চাইলে এই সিভিল সার্জন বলেন, ‘আমরা তানিয়ার শরীর থেকে প্রাপ্ত মেটিরিয়াস ঢাকা মহাখালীতে ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠিয়েছি। ওই প্রতিবেদন আসার পর জানা যাবে কতজন ধর্ষণে জড়িত ছিল।’
এদিকে শনিবার রাতে বাসের চালক নূরুজ্জামানের জবানবন্দি রেকর্ড করেন কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল-মামুন। আদালত ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জবানবন্দিতে নূরু জানিয়েছে, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কের বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের গজারিয়া বিলপাড় এলাকায় রাস্তার পাশে প্রথমে চালক নূরুজ্জামানের খালাতো ভাই বোরহান তানিয়াকে বাসের ভেতরে ধর্ষণ করে। পরে চালক নূরুজ্জামান এবং শেষে হেলপার লালন নার্স তানিয়াকে ধর্ষণ করে।
ধর্ষণের সময় বাসের হেলপার লালন নার্স তানিয়ার ঠোঁটে কামড় দিলে তানিয়া তাকে সজোরে লাথি মেরে বাঁচার জন্য বাসের ভেতর ওঠে দাঁড়ান। এ সময় চালক নূরুজ্জামান হঠাৎ ব্রেক করে। এতে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে বাস থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান তানিয়া।
এ অবস্থায় হেলপার লালন তানিয়াকে ফেলে যাওয়ার জন্য বললে চালক তাতে রাজি হয়নি। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। এ সময় চালক বাস থামিয়ে দিলে রাস্তায় চলাচলকারী দুটি মোটরসাইকেল ও একটি অটো সেখানে আসে। তাদের জানানো হয়, মেয়েটি বাস থেকে পড়ে গেছে। পথচারীদের সহযোগিতায় তানিয়াকে আবারও বাসের ভেতর তোলা হয়। তখনো জীবিত ছিলেন তানিয়া।
চালক, হেলপার ও বোরহান মিলে তানিয়াকে বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর বাজারে সততা ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকানে নিয়ে যায়। ফার্মেসির মালিক তানিয়ার শরীরের রক্ত মুছে দিয়ে অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ভাগলপুর জহুরুর ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। ঘটনাটি পিরিজপুরে স্বর্ণলতা বাসের কাউন্টার মাস্টার আলামিনকে জানানো হয়। আলামিন, বোরহান ও অন্য আরেক ব্যক্তি মেয়েটিকে কটিয়াদী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আবারও বাসে উঠায়। এ সময় হেলপার লালন পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পালিয়ে যায়।
রাত ৯টার দিকে তানিয়াকে বাসে রেখে কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে বাসের চালক। আলামিন ও বোরহানকে সিএনজি আনতে বললেও তারা বাস থেকে নামতে রাজি হয়নি। এ অবস্থায় চালকও বাস থামিয়ে বসে থাকে। একপর্যায়ে আলামিন মেয়েটিকে নিয়ে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। কথামতো চালক নূরুজ্জামান বাস চালিয়ে কাপাসিয়ার দিকে যায়। কটিয়াদী উপজেলার বেতাল যাওয়ার পর সুপারভাইজার আলামিন চালককে জানায়, স্বর্ণলতা বাসের এমডি পাভেল তানিয়াকে কটিয়াদী হাসপাতালে রেখে যেতে বলেছেন।
জবানবন্দিতে চালক নূরুজ্জামান জানায়, এ অবস্থায় সেখানে বাস থামিয়ে ২০-২৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি। মেয়েটি তখনো জীবিত এবং হাত-পা নাড়ছিল। একসময় রফিক নামে বাসের এক লাইনম্যান আসে। সে বেতাল বাজারে ফোনে কথা বলছিল। তখোন বাসের ভেতর তানিয়া ছাড়া বোরহান, আলামিন ও কালো করে আরেক ব্যক্তি ছিল। তখন আমি বাস থেকে নেমে নিজেই অটোরিকশা আনতে যাই। অটোরিকশা নিয়ে এসে আলামিন ও রফিকের কাছে মেয়টিকে বুঝিয়ে দেই। আমি বাস নিয়ে চলে যাই।
চালক জানায়, মেয়েটিকে ধর্ষণের সময় তার মাথা পেছনের দিকে এবং পা বাসের সামনের দিকে ছিল। চালকের খালোতো ভাই ধর্ষণের সময় চালক নূরুজ্জামান পেছনে এবং হেলপার লালন সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত ১১টার দিকে জানতে পারি মেয়েটি মারা গেছে।
দীর্ঘ জবানবন্দিতে মামলার প্রধান আসামি নূরুজ্জামান জানায়, ৬ মে ৪টা ১৫ মিনিটে ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে তানিয়া তার বাসে ওঠে। এরপর বাসটি টঙ্গী স্টেশন, গাজীপুর চৌরাস্তা, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা, কাপাসিয়া, টোক হয়ে উজুলি আসলে তার খালাতো ভাই বোরহান বাসে ওঠে। তারপর থানাঘাট, যাত্রাঘাট, বেতাল বাজার এলাকায় বাসের কিছু যাত্রী নেমে যায়। রাত ৮টার সময় বাসটি কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ডে আসে। সেখানে ২০-২২ জন যাত্রী নেমে যায়।
নূরুজ্জামান জানায়, পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেলপার লালনকে বাসটি চালাতে বলি। কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ড ছাড়ার সময় বাসটিতে আমি, হেলপার লালন, আমার খালাতো ভাই বোরহান, নিহত মেয়েটি এবং আরও দুইজন যাত্রী ছিল। কটিয়াদীর কদমতলীতে একজন এবং বাজিতপুরের উজানচরে অন্য একজন যাত্রী নেমে যায়। এ সময় মেয়েটি বাসে একা বসে থাকে। আমি বাসের পেছনের সিটে বসে সিগারেট খেতে থাকি। লালন তখন মেয়েটিকে পেছনের সিট থেকে সামনের সিটে এসে বসার জন্য বলে। মেয়েটি তার সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র নিয়ে সামনের সিটে যাওয়ার সময় বোরহান তাকে ইচ্ছা করে ধাক্কা দেয়।
মেয়েটি তখন বোরহানকে গালি দিলে বোরহান মেয়েটিকে জাপটে ধরে বাসের মাঝখানে যাত্রীদের চলাচলের পথে ফেলে দিলে মেয়েটি কান্নাকাটি শুরু করে। একপর্যায়ে তাকে ধর্ষণ না করতে চাই পা ধরে কান্না শুরু করে। কিন্তু বোরহান আকুতি-মিনতি না মেনে মেয়েটিকে ধর্ষণ করতে থাকে। এ সময় হেলপার লালন বাস চালাচ্ছিল। সে গজারিয়া বিলপাড় এলাকায় একটি কলা বাগানের কাছে বাস থামিয়ে দেয়।
প্রসঙ্গত, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের পিরিজপুর রুটে চলাচলকারী স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে গত ৬ মে তানিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বাজিতপুর উপজেলার গজারিয়ায় কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। ওই দিন ঢাকা থেকে কটিয়াদী ও বাজিতপুরের পিরিজপুর হয়ে নিজ গ্রামে ফিরছিলেন তানিয়া। তিনি কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরি ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের মো. গিয়াসউদ্দিনের মেয়ে।
তানিয়া ঢাকার কল্যাণপুরে ইবনে সিনা হাসপাতালে সেবিকা পদে কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় বাসের চালক নূরুজ্জামান নুরু (৩৯) ও সহকারী লালন মিয়াসহ (৩২) মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।