Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

থামছে না বালু উত্তোলন, হুমকির মুখে আত্রাইয়ের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ 

ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৩:০০ PM
আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৫:৪৬ PM

bdmorning Image Preview


নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার আত্রাই নদীর মহিশবাথান ঘাটে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে নদীর তীর ঘেঁষে বাঁধের কংক্রিটের ব্লক (সিসি) ধসে পড়ে হুমকির মুখে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। তীরবর্তী বাসিন্দারা আশঙ্কা করছেন আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বাঁধে ভাঙন দেখা দিতে পারে। বাঁধটি ভেঙে পড়লে সরকারি খাদ্য গুদাম, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১৪-১৫টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) অফিসসহ অন্তত ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মহিশবাথান ঘাটে একই স্থানে সারি বেধে ১০ থেকে ১২টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে এক বছরের বেশি সময় ধরে ড্রেজিং করে বালু উত্তোলন করে আসছে একটি প্রভাবশালী মহল। নদীর তলদেশে গভীর গর্ত করে মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করায় সিসি ব্লকের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে সিসি ব্লক নদীতে ধসে পড়ছে। ফলে ফসলি জমিসহ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে এলাকার প্রায় আধা কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থান নদীতে ধসে পড়ায় গত ১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার এলাকাবাসী বালু উত্তোলনে বাধা প্রদান করে।

গত বুধবার দুপুরে মহিষবাথান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ড্রামের সাহায্যে নদীতে ৬টি মেশিন ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। এসব যন্ত্রের সাহায্যে নদীর তলদেশে গর্ত করে বালু তোলা হচ্ছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে 'মহাদেবপুরে নীতিমালা উপেক্ষা করে বালু উত্তোলনের মহোৎসব' শিরনামে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় নড়ে চরে বসে উপজেলা প্রশাসন। সে সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোবারক হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসমা খাতুন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। প্রশাসনের বাধার মুখে বালু উত্তোলনকারীরা কয়েকটি ড্রেজার মেশিন (খননযন্ত্র) তুলে নেয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে চলে আসার পর তারা আবার ড্রেজিং করে বালু তুলতে থাকে।

প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে বালু উত্তোলন করলে বুধবার সন্ধ্যায় ইউএনও আবারও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আগমন টের পেয়ে বালু উত্তোলনকারী ও ট্রাক ড্রাইভাররা ট্রাক ফেলে পালিয়ে গেলে ট্রাকের চাকার হাওয়া ছেড়ে দেয়া হয়।

এলাকাবাসী জানায়, নদীর পানি কমে যাওয়ায় দু-তিন মাস ধরে মেশিন দিয়ে বালু তোলা বেড়ে গেছে। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বালু তোলা হয়। প্রশাসন এসব যন্ত্র বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়। তখন দু-এক দিন বালু তোলা বন্ধ থাকে। কিন্তু পরে আবার শুরু হয়। নীতিমালা উপেক্ষা করে সারি বেধে কয়েক হাত পর পর মেশিন বসিয়ে নদী গর্ত করে ওই এলাকায় চলে বালু উত্তোলনের মহোৎসব।

প্রতিদিন শত শত ট্রাকে করে তা বিক্রি করে বিশেষ একটি মহল হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারকি না থাকায় একটি প্রভাবশালী মহল মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে। যে কারণে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। ফলে বালু উত্তোলনকারীরা বেপরোয়া।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এর ধারা ৫-এর ১ উপধারা অনুযায়ী, পাম্প, খননযন্ত্র (ড্রেজিং) বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ধারা ৪ এর (খ) অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেল লাইন ও অনান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা হলে অথবা আবাসিক এলাকা হতে সর্বনিম্ন ১ কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আত্রাই নদী থেকে বালু তোলার ক্ষেত্রে আইন মানা হচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালু তোলার কাজে জড়িত কয়েকজন শ্রমিক জানান, প্রশাসনের লোকজন অভিযানে আসার আগেই এলাকায় খবর চলে আসে। এ কারণে কর্মকর্তারা আসার আগেই ব্যবসায়ীরা মেশিন সরিয়ে নেয়। অভিযানের পর সুযোগ বুঝে আবার বালু তোলা  হয়।

তারা আরো জানান, আমরা পেটের দায়ে এখানে বালু তোলার কাজ করি। কিন্তু আমাদের মালিকেরা বালু বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করে না।

মহিষবাথান গ্রামের আরেকজন শ্রমিক জানান, উপজেলার পুরো বালুমহালে আগে এক থেকে দেড় হাজার শ্রমিক বালু তোলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ড্রেজার দিয়ে বালু তোলায় অর্ধেক শ্রমিকই এখন বেকার হয়ে পড়েছে।

নদী পারের এক গৃহবধু জানান, সারা বছর বালু উত্তোলন করার ফলে বর্ষা মৌসুমে নদী ভরে যাওয়ার পর যখন নদীর পানি কমে যায় তখন বাঁধের সিসি ব্লব ধসে পড়ে।

তিনি আরো জানান, বালু আনা নেয়ার জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করছে বালু ব্যবসায়িরা। এসব ট্রাক্টর গ্রামের রাস্তা-ঘাটের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। বালু বহনকারী ট্রাক-ট্রাক্টর চলাচলে ধুলো-বালি উড়ে রাস্তার দু-পার্শ্বের বাড়ি ঘর বসবাসের অযোগ্য ও জন স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোবারক হোসেন জানান, ‘মহিশবাথান ঘাটে তিন দফায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। খননযন্ত্র ব্যবহার করা দ-নীয় অপরাধ। নীতিমালা লঙ্ঘন করে কেউ বালু তুললে অবশ্যই তাদেরর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নওগাঁর নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকারের সথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘বাঁধ হুমকির মুখে তা আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। দ্রুত ওই এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। কোন ক্রমেই বাঁধের ক্ষতি করতে দেয়া যাবে না।’ 

Bootstrap Image Preview