Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

নিয়মের তোয়াক্কা না করেই এলপিজি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে দেশজুড়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১ এপ্রিল ২০১৯, ১০:৪০ PM
আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৯, ১০:৫৫ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: বিডিমর্নিং


‘বোতল একটা লইয়া গেলাম’-এই বলে হেচকা টানে ওমেরার ২৪ কেজি ওজনের এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাসের বোতলটি সাইকেলে তুলে নিলো এক কিশোর। দোকানের দিকে চোখ যেতেই দেখা গেলো, গাদাগাদি অবস্থায় দু-তিন কোম্পানির সিলিন্ডারের বোতল মজুদ করা রয়েছে। বিধিমালার কোনো নিয়মের মধ্যেই পড়ছে না গোটা চিত্রের কোনো একটি অংশও।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১অনুসারে সিলিন্ডার পরিবহনের বিষয়ে বিধিমালার চতুর্থ পরিচ্ছেদে বলা আছে, গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার কোন দ্বিচক্রযানে (মোটরসাইকেল, সাইকেল) পরিবহন করা যাবে না।

সরকারি নিয়ম নীতি না মেনে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মুদি দোকান সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে এই জীবননাশী এলপিজি গ্যাস। বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের আশঙ্কা অনিয়মের কারণে যে কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে নগরবাসী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি এই অনিয়মের বিরুদ্ধে শীগ্রই অভিযান চালাবে তারা।

বিস্ফোরক আইন ১৮৮৪-এর অধীনে গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ২০০৪-এর ৬৯ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া অনধিক ১০টি গ্যাসপূর্ণ সিলেন্ডার বা ১২৫ কেজি গ্যাস মজুদ করতে পারবে এবং বিধির ৭০ ধারা অনুযায়ী সিলেন্ডার মজুদ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং আগুন নিয়ন্ত্রক সরঞ্জাম মজুদ রাখতে হবে। সিলিন্ডার গ্যাস স্থাপনা প্রাঙ্গণে দিয়াশলাই বা আগুন লাগতে পারে এমন কোনো বস্তু বা সরঞ্জাম রাখা যাবে না। মজুদ করা স্থানের কাছাকাছি আলো বা তাপের উৎস থাকা যাবে না।

কিন্তু রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন কাটাশুর মৌজার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা এলাকার চিত্র বলছে উল্টো কথা। নিয়মের তোয়াক্কা না করেই এই এলাকায় সর্বত্র বিক্রি হচ্ছে এলপিজি গ্যাস।

রাস্তার পাশে খোলা স্থানে একত্রে ১০টির বেশি গ্যাস সিলিন্ডার রেখেই বিক্রি করা হচ্ছে এই ‘জীবননাশী বোমাগুলো’। দোকানগুলোতে নেই কোনো আগুন নির্বাপন ব্যবস্থা। বেশিভাগ দোকানদারই জানেন না ১০টি গ্যাসপূর্ণ সিলেন্ডার বা ১২৫ কেজি গ্যাস মজুদ জন্য দরকার সরকারি অনুমোদন।

মোহাম্মদপুরের আল্লাহ করিম মার্কেটের বিপরীত পাশে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা করে আসছে মোল্লা এন্টারপ্রাইজ। তবে এতো দীর্ঘ সময়কাল ধরে এ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও এখন পর্যন্ত বিস্ফোরক পরিদপ্তেরর লাইসেন্স করেনি তারা।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স এখনো করা হয়নি কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে মোল্লা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুর রব মোল্লা বিডিমর্নিংকে বলেন, ‘আবেদন করেছিলাম কিন্তু লাইসেন্সের কাজ সম্পন্ন করা হয়নি। মূলত অবহেলার কারণে লাইসেন্স করা হয়নি’।

শুধুমাত্র আবেদন করে কীভাবে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকায় যারা ব্যবসা করছেন তাদের বেশিরভাগই লাইসেন্স নাই। আর এ ব্যবসা করতে আসলে লাইসেন্স দরকারও হয় না। কোনো একটি কোম্পানিতে যখন ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য কথাবার্তা বলা হয় তখন তারা শুধু আমাদের দোকানের জায়গা ঠিক করতে বলে। বাকি কাজ কোম্পানি থেকেই ম্যানেজ করে দেওয়া হয়।

আব্দুর রব মোল্লার মতো এমন আরো অনেক ব্যবসায়ই আছে যাদের বিস্ফোরক কিংবা ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স দূর দোকানের ট্রেড লাইসেন্সও নাই। বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই নিয়ম না মেনে ব্যবসা করছে। নিয়ম মেনে ব্যবসা করছে এমন ব্যবসায়ী মার্কেটে নেই বললেই চলে। এমনকি লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা সে বিষয়েও অনেকের ধারণা নেই।

বসিলা গার্ডেন সিটির ২নং রোডে অবস্থিত তাহামিদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ২ বছর যাবত গ্যাসের খুচরা ব্যবসা করছি। কিন্তু সিলিন্ডারের ব্যবসা করতে লাইসেন্স দরকার হয় এটা আমার জানা ছিল না’।

সরেজমিন তথ্য বলছে এলাকাভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউটররা ৫০০ কেজি গ্যাস মজুদের আবেদন করে থাকলেও ১০০০ কেজিরও অধিক গ্যাস তারা মজুদ করছে।

বসিলা গার্ডেন সিটির সততা এন্টারপ্রাইজ নামের এক সিলিন্ডার গ্যাসের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডারের বোতল মজুদ করা আছে। কিন্তু সে ৪০টি গ্যাস সিলিন্ডার মজুদের তথ্য দিয়ে লাইসেন্সের আবেদন করেছে।

৫০০ কেজির বেশি গ্যাস কেনো মজুদ করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে দোকানি বলেন, ‘এটা আমাদের শো-রুম এখানে আপাতত গ্যাসগুলো রাখা হয়েছে। আমাদের গোডাউন তৈরির কাজ চলছে। গোডাউন তৈরি হলে বাকি মাল সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুরের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের এখানে কেউ নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন না। এখানে ব্যবসা করা কারো কোনো লাইসেন্স নেই। নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব না। নিয়ম অনুযায়ী আমরা মজুদ করতে পারবো ৪০টি গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডারের বোতল। কিন্তু বাজারে এর চেয়ে বেশি চাহিদা আছে। আর নিয়ম মেনে এতো কম মাল মজুদ করে আমাদের পেট চালানো সম্ভব না’।

এবিষয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তর এর প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, লাইসেন্সহীন দোকানগুলো সিলগালা করার ক্ষেত্রে তারা বরাবরই তৎপর কিন্তু জনবল না থাকার কারণে একটু বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।

শুধুমাত্র আবেদন করেই লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত ব্যবসা পরিচালনার প্রসঙ্গে তিনি বিডিমর্নিংকে বলেন, ‘লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করা সম্পুর্ণ বেআইনি।

তা ছাড়া তিনি আরো জানান, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের আইন অনুযায়ী অভিযান দেওয়ার জন্য যে ধারা প্রয়োজন তা তাদের নেই। কিন্তু অভিযান পরিচালনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে একটি আবেদন পাঠানো হয়েছে। যা শীঘ্রই পাস হবে। আর এই খসড়া অনুমোদনের পর পরই বিস্ফোরক পরিদপ্তর অবৈধভাবে যারা এলপি গ্যাস বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবেন।

শামসুল আলম আরো বলেন, ‘আমাদের পাশাপাশি লোকাল প্রশাসনকেও সচেতন হতে হবে। যেমন ধরুন সিটি কর্পোরেশন তাদেরকে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স দিচ্ছে। তাদের একটু সচেতন হওয়া উচিত। এছাড়া এলাকার কমিশনার কে তদারকি করতে হবে। কারণ সচেতনতা গড়ে না উঠলে এই অনিয়ম বন্ধ করা অনেক কঠিন’।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর মোরশেদ শাহরিয়ার এ বিষয়ে বিডিমর্নিংকে বলেন, যারা ডিলার তারা মুনাফার জন্য ছোট দোকানগুলোতে নিয়মনীতি না মেনে সিলিন্ডার দিয়ে থাকেন। যা নিয়মের বহির্ভূত।

তিনি আরো বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা এসব অনিয়মের বিষয়ে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি এবং সামনে আরও কঠোর হস্তে এই অনিয়ম দমন করার জন্য কাজ করবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’।

প্রসঙ্গত, সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে এলপিজি গ্যাস বিক্রি হলেও এর লাইসেন্স গ্রহণ করেছে এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ হাজার। আর যাদের অনেকেই আবার এখন পর্যন্ত তা নবায়ন করেনি। এর সঠিক পরিসংখ্যান চাওয়া হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তর এর প্রধান পরিদর্শক শামস আলম তা দিতে ব্যর্থ হন।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১ অনুসারে এলপিজি গ্যাস বিক্রি জন্য কমপক্ষে পাকা ফ্লোরসহ আধা পাকা ঘর থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা সংক্রান্ত লাইসেন্স ও ছাড়পত্রসহ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এক্সস্টিংগুইশার মজবুত এবং ঝুঁকিমুক্ত সংরক্ষণাগার থাকতে হবে।

সিলিন্ডার আমদানির বিষয়ে বিধির তৃতীয় পরিচ্ছেদে বলা আছে, লাইসেন্স ছাড়া সিলিন্ডার আমদানি নিষিদ্ধ। কোন ব্যক্তি বিনা লাইসেন্সে গ্যাসপূর্ণ বা খালি সিলিন্ডার আমদানি করতে পারবেন না।

সিলিন্ডার পরিবহনের বিষয়ে বিধিমালার চতুর্থ পরিচ্ছেদে বলা আছে, গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার কোন দ্বিচক্রযানে (মোটরসাইকেল, সাইকেল) পরিবহন করা যাবে না।

বিধিমালার সপ্তম পরিচ্ছদে বলা আছে, লাইসেন্স ব্যতীত সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ। বিধি-৪১ এর বিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি বিনা লাইসেন্সে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করতে পারবেন না অথবা গ্যাসপূর্ণ কোন সিলিন্ডার তার অধিকারে (মজুদ) রাখতে পারবেন না।

Bootstrap Image Preview