Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

গুলি-ব্রাশফায়ারে এক মুহূর্তেই উড়ে গেল গাড়ি, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম সবাই

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ মার্চ ২০১৯, ০৬:২৯ PM
আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯, ০৯:৫৩ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে হতাহতের ঘটনায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ ঘটনায় বাঘাইছড়িতে নিহত ৫ জনের দাফন ও ২ জনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।

বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গাড়ীতে দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে হতাহতের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বুধবার সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটিতে বৈঠকে বসবেন।

ব্রাশফায়ার ও নৃশংস হামলার বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া আনসার সদস্য হাবিবুর। তিনি বলেন ‘আমরা সবাই মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্বে ছিলাম। আমাদের কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ফলাফল ঘোষণা শেষে বিকেল ৫টার দিকে আমরা সবাই জিপ গাড়িযোগে বাঘাইছড়ি উপজেলায় ফিরছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়কের নয়মাইল এলাকায় পৌঁছালে আমাদের গাড়িতে গুলি এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা চমকে উঠি। গুলির পরপরই দুই পাহাড় থেকে ব্রাশফায়ার চালানো হয়। গুলি আর ব্রাশফায়ারের এক মুহূর্তেই উড়ে গেল আমাদের গাড়ি। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম আমরা সবাই। এসব ঘটনা এক মিনিটের মধ্যেই ঘটেছে।’

এদিকে সোমবার রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনের দায়িত্ব শেষে সীমান্তবর্তী এলাকা সাজেক ইউনিয়ন থেকে ফেরার পথে এ হামলার মুখে পড়েন তারা। এ হামলায় সাতজন নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে আনসার সদস্য হাবিবুর গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পাশাপাশি আহত হয়েছেন অন্তত ১৪ জন।

আনসার সদস্য হাবিবুর বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ শেষে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। যেহেতু ভোট নিয়ে আমাদের কেন্দ্রে কোনো অনিয়ম হয়নি সেহেতু আমরা ছিলাম ভয়মুক্ত। কে জানতো এমন ঘটনা ঘটবে। নয়মাইল এলাকায় আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তিনটি জিপ গাড়ির ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আমাদের গাড়িচালক গাড়ি না থামিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দেন। এ সময় সন্ত্রাসীরা চারদিক থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে আমাদের কয়েকজনের শরীরে গুলি লেগে আহত হন।

তিনি আরও বলেন, মূলত দুই পাহাড়ে অবস্থান করেছিল সন্ত্রাসীরা। দুই পাহাড় থেকে প্রথমে গুলি ছোড়া হয়। এর পরপরই ব্রাশফায়ার চালানো হয়। এতে আমাদের গাড়ি উড়ে যায়। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাই সবাই। এরপর কি হয়েছে আমি জানি না, চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালে।

সোমবার (১৮ মার্চ) দেশের বিভিন্ন স্থানের ১১৫টি উপজেলার সঙ্গে বাঘাইছড়ি উপজেলাতেও ভোট হয়। তবে পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে সকালেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এরপর সন্ধ্যায় ঘটে ওই হত্যাকাণ্ড।

এদিকে মঙ্গলবার সকালে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তাকে হত্যার সময় ছেলে নিরুপম তঞ্চঙ্গ্যা (২৮) বাবার সঙ্গে ছিলেন।

নৃশংস ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিরুপম তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমাদের বাড়ি বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নে। আমরা নিরাপত্তার কারণে বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে বসবাস করি। নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য আমরা এলাকায় যাই। ভোট দিয়ে উপজেলা সদরে আসার সময় আলিক্ষ্যং এলাকায় আমার বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমার বাবা নির্বাচনী প্রতিহিংসার শিকার।

তিনি বলেন, ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে ফারুয়া থেকে উপজেলা সদরে আসছিলাম আমরা। আলিক্ষ্যং এলাকায় পৌঁছালে হঠাৎ নৌকা থামান মাঝি। আমি কারণ জানতে চাইলে মাঝি বলেন আমাকে তীরে নৌকা থামাতে বলছে ওরা। মাঝিকে নৌকা চালাতে বললে মাঝি বলেন তারা গুলি ছুড়ছে। পরে মাঝি নৌকা থামান তীরে। নৌকা থামাতেই অস্ত্রধারী তিনজন আমার মাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। আমার বাবাকে নামিয়ে নিয়ে গুলি করে চলে যায় তারা। চার মিনিটের মধ্যে বাবা প্রাণ হারান, সেই সঙ্গে আমরা এতিম হয়ে যাই। আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই।

পাহাড়ের এ দুই ঘটনায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আতঙ্কে আছেন উপজেলাবাসী। এখন পর্যন্ত এসব হামলার ঘটনায় মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছুফিউল্লাহ।

তিনি বলেন, বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে নিহত ছয়জনের ময়নাতদন্ত খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ বাঘাইছড়ি নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

এদিকে নিহত ও আহতরা সবাই কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট এলাকায় নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন।

সেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম ব্লক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তারের কাছে। নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও চোখের সামনে সহকর্মীদের খুন হতে দেখার পর স্বাভাবিক হতে পারছেন না এই শিক্ষিকা। 

পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে ইয়াসমিনকে পাঠানো হয়েছিল বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। দুর্গম পাহাড়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে রবিবার দুপুরেই তারা কেন্দ্রে পোঁছে যান। সোমবার সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। 

ইয়াসমিন আক্তার বলেন, পুরোটা সময় বেশ ভালোভাবে যাচ্ছিল। ভোটাররা এসে ভোট দিচ্ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। কোনো গণ্ডগোল ছাড়াই বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হল। এরপর আমরা গণনাও শেষ করলাম।

তিন বলেন, ওই কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা অনুসারী অংশের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। তার প্রতীক ছিল ঘোড়া। সুদর্শনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমার অনুসারী অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের গত মেয়াদের চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা ভোটের সকালেই জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে তার প্রতীক ছিল দোয়াত কলম।

শিক্ষিকা ইয়াসমিন জানান, ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা প্রায় ২৫ জন গাদাগাদি করে একটি চাঁদের গাড়িতে উঠে রওনা হন বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ছাড়াও পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা ওই গাড়িতে ছিলেন।

তিনি তার বর্ণনায় বলেন, আমাদের গাড়ি যখন বাঘাইহাট পৌঁছায়, তখন সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও দুটো চাঁদের গাড়ি। সাজেক ইউনিয়নের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেশে ভোটগ্রহণকর্মীরা ওই দুটি গাড়িতে করে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন। আমাদের তিনটি গাড়ি তখন একসঙ্গে বাঘাইছড়ির দিকে রওনা করলো। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বিজিবির একটা টহল গাড়ি। চারটি গাড়ির বহর, সবার সামনে বিজিবির গাড়ি। তার পেছনেই ছিল আমাদের গাড়িটা।

ইয়াসমিন জানান, তাদের গাড়িগুলো নয়মাইল এলাকায় পৌঁছানোমাত্র পাশের উঁচু পাহাড় থেকে পেছনের তিনটি গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি শুরু হয়। কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো থামেনি। গুলি উপেক্ষা করে চালকরা গাড়ি টেনে চালিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। এ এক বিভৎস অভিজ্ঞতা। কান্না, চিৎকার, রক্ত...।

তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, রক্তাক্ত চাঁদের গাড়ি থেকে নামানোর পর একে একে মারা ছয়জনের মৃত্যু হয়। রাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরও একজন।

‘সারা দিন আমরা একসাথে কাজ করলাম, সেই মানুষগুলো একের পর এক…,’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়াসমিন আক্তার।

তিনি বলেন, এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার সহকর্মী আমির হোসেন, তৈয়ব আলী মারা গেছে। আমার বান্ধবী কাঞ্চি, বড় ভাই বদিউজ্জামান, ওরা গুরুতর আহত। হতাহত সবাইতো আমার কমবেশি চেনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন তাদের মরতে হল?

‘কবে বন্ধ হবে এইসব বর্বরতা। আর কত লাশ পড়বে পাহাড়ে? এর মধ্যে কীভাবে আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করব?’

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে করে ইয়াসমিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন কিংবা যে কোনো সরকারি দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই কঠিন। আমাদেরকে নানা ধরনের চাপে থাকতেই হয়। কিন্তু এরকম ভয়াবহ বর্বরতা ভবিষ্যতে আমাদের আরও বেশি চাপে ফেলবে। আমি অনুরোধ করি, আপনি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।

পুলিশ জানায়, উপজেলার ৯ কিলোমিটার এলাকায় নির্বাচন কর্মকর্তারা ভোটগ্রহণ শেষে উপজেলা সদরে আসার পথে সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

উল্লেখ্য, ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর এক ঘণ্টা পর নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

Bootstrap Image Preview