Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

যেভাবে আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে উঠেছিল পলান সরকার

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ মার্চ ২০১৯, ০৯:৫৭ PM
আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৯, ০৯:৫৭ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


এক অশীতিপর বৃদ্ধ, কাঁধে একটি ঝোলা আর ঝোলাভর্তি বই, চোখে মোটা কাঁচের ঘোলাটে চশমা, গায়ে সাদামাটা পাঞ্জাবী। হাঁটছেন গাঁয়ের কোনো মেঠো রাস্তা ধরে। পাশের ধানক্ষেত থেকে কেউ বলে উঠলো একটি বই দেন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। গ্রামীণ জনপদের অশিক্ষার অন্ধকারের আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠা একুশে পদকপ্রাপ্ত পলান সরকারের শৈশব কাটে নাটোরের বাগাতিপাড়া।

পলান সরকার ১৯২১ সালে নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচ মাস বয়সে তার বাবা হায়াত উল্লাহ সরকার মৃত্যুবরণ করেন। এরপর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শেষে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে চলে যান তিনি।

পলান সরকারের দাদার নাম ছমির সরকার। তাদের অন্য বংশধররা এখনও বাগাতিপাড়ার নূরপুর মালঞ্চি গ্রামেই বসবাস করেন।

পলান সরকারের নিজের চাচাত ভাইয়ের ছেলে অধ্যক্ষ মামুনূর রশীদ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, পলান সরকারের শৈশব বাগাতিপাড়ার নূরপুর মালঞ্চি গ্রামে কেটেছে। নূরপুর মালঞ্চি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পলান সরকারের হাতেখড়ি।

সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর অর্থনৈতিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। এরপর তার নানা ময়েন উদ্দিন সরকার মা মইফুন নেসাসহ পলান সরকারকে রাজশাহীর বাঘার উপজেলার বাউসা গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান।

সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। তার বাবা-মা নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার।

তবে জন্মের পর থেকেই মা 'পলান' নামে ডাকতেন। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে পলান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস থেকে যায় আজীবন।

তার নানা ময়েন উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। যৌবনে পলান সরকার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন এবং দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে ১৯৬২ সালে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান।

নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন তিনি। ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তিনিই আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন।

অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জাগ্রত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।

১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর প্রচারবিমুখ পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন।

বই বিতরণ

১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার।

এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাদেরও বই দেবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষ ও তার কাছে বই চাইতে শুরু করে।

১৯৯২ সালে তার ডায়াবেটিকস ধরা পড়লে ডাক্তার তাকে নিয়মিত ৩-৪ কিলোমিটার হাঁটার পরামর্শ দিলেন। এই হাঁটাকে তিনি ভিন্নভাবে কাজে লাগালেন। শুধু স্কুল ভিত্তিক বই বিতরণ না করে বাড়ি বাড়ি বই বিতরণের কথা ভাবলেন। যেই ভাবা সেই কাজ।

এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, আমি ভেবে দেখলাম, যারা আমার বাড়ি থেকে বই নিয়ে যায়, আমি নিজেই তো হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। সেই থেকে শুরু। এক বাড়িতে বই দিতে গেলে তার দেখাদেখি আরেক বাড়ির লোকেরাও বই চায়। বই নিয়ে হাঁটা আস্তে আস্তে আমার নেশায় পরিণত হলো।

তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়িতে বাড়িতে বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন।

এছাড়া যারা তার বাউসা বাজারে থাকা চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন। তার কর্মকাণ্ড সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

এলাকার চায়ের দোকানি পর্যন্ত হয়ে ওঠে বইপাগল, প্রতি বিকালে তার দোকানে বসে বই পড়ার আসর। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে।

অর্জন ও সম্মাননা

প্রথমে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষই জানত পলান সরকারের এই শিক্ষা আন্দোলনের গল্প। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি তাকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে পলান সরকারের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

তিনি ২০১১ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক 'অবদান'।

বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সবার মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে 'সাদা মনের মানুষ' খেতাবে ভূষিত করে।

অবশেষে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের বাড়িতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ১ মার্চ শুক্রবার দুপুরে পরপারে পাড়ি জমান এই আলোকিত মানুষ পলান সরকার।

Bootstrap Image Preview