Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘আসল’ মোড়কে জটিল রোগের নকল ওষুধ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১০:০৫ AM
আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১০:০৫ AM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


‘আসল’ না ‘নকল’ বোঝা কঠিন। চকচকে মোড়কে মোড়ানো পণ্য মানেই যে ‘আসল’ তা কিন্তু নয়। বরং আসলের চেয়ে ‘নকল’ পণ্যের প্যাকেট অধিক উন্নত, বেশি চকচকে। হুবহু ‘আসল’ মোড়কে ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে একটি চক্র। যা দেখে ভোক্তাদের আসল-নকল পরখ করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। অভিযোগ রয়েছে, এ চক্রকে সহযোগিতা করছে অতি মুনাফালোভী কতিপয় ফার্মেসি মালিক।

তাদের কাছ থেকে নকল ও ভেজাল ওষুধ কিনে খেয়ে সুস্থ হওয়ার বদলে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে নানারকম রোগ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অভিযানে বিভিন্ন সময় নকল ওষুধসহ চক্রের সদস্যরা ধরা পড়লেও তাদের তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। এজন্য ওষুধ তৈরির অবৈধ কেমিক্যাল বিক্রি বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকা ও কেরানীগঞ্জে ওষুধ নকল চক্রের ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এরা ওষুধ তৈরিতে পারদর্শী। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে অনিয়মের কারণে চাকরিচ্যুত হয়ে নিজেরা শুরু করেছেন নকল ওষুধ উৎপাদন। লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর এবং কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করে তা মিটফোর্ডের কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের বাজারে। তাছাড়া ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের ওষুধ নকল চক্র সক্রিয় রয়েছে।

২ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশ ওষুধ নকলকারী একটি চক্রের হোতা আবদুস সোবহানসহ ৫ জনকে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করেছে। আবদুস সোবহান একটি ওষুধ কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত। পরে সে আরও কয়েকজনকে নিয়ে নকল ওষুধ তৈরি শুরু করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ইনসুলিন, প্যাথেডিনসহ জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের হুবহু নকল ওষুধ। এর আগে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড টাওয়ার ও হাবিব মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ক্যান্সারের ওষুধ, ইনসুলিন, হৃদরোগের ওষুধসহ দুই কোটি টাকার নকল ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করে র‌্যাব।

এর আগে ১ আগস্ট মিটফোর্ডে ওষুধ মার্কেট থেকে ২০ কোটি টাকার নকল ও সরকারি ওষুধ জব্দ করা হয়। ৫০টি ফার্মেসিকে ৬০ লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করা হয়। ২৪ জুলাই মিটফোর্ডে ৩২টি দোকানকে ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মালিককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৮ মে মিটফোর্ড এলাকায় ১৫ কোটি টাকার নকল ওষুধ জব্দ এবং ৫ জনকে ২ বছর করে কারাদণ্ড দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাঁতীবাজার থেকে রুহুল আমিন ওরফে দুলাল চৌধুরী, নিখিল রাজবংশী ও মোহাম্মদ সাঈদ নামে তিনজনকে ক্যান্সার ও বিভিন্ন জটিল রোগের ৪০ হাজার পাতা নকল ওষুধসহ গ্রেফতার করা হয়। এরা চীন থেকে নকল ওষুধ তৈরি করে এনে দেশে বাজারজাত করত।

র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির নাম, লেবেল ও লোগো হুবহু নকল করে এসব ভুয়া ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে।

ওষুধ কাঁচামালের গোপন বাজারের মধ্যে দিয়ে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে ওষুধ তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল বিক্রি হয় পুরান ঢাকার বিভিন্ন কেমিক্যালের দোকানে। এসব দোকান থেকে কাঁচামাল কিনে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ বিভিন্ন চক্র। এমোক্সাসিলিন, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম, মেট্রো, ফ্লুক্লোনাজল, সিফিকজিম, সিপরো, রেনিটিডিনের মতো ওষুধ তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কেমিক্যাল গোপনে বিক্রি হয় পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায়। ১৯৯৩ সালে রিড ফার্মা নামে একটি কোম্পানির প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ২৮ শিশুর মৃত্যুর ঘটনার তদন্তেও উঠে আসে- অভিযুক্ত ওই ওষুধ কোম্পানি মিটফোর্ড এলাকা থেকে ওষুধের কেমিক্যাল (এপিআই) কিনেছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোপন বাজারে ওষুধের কেমিক্যাল বিক্রি বন্ধ করা গেলেই নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী চক্রকে দমানো সম্ভব। কারণ অবৈধভাবে কেমিক্যাল কিনতে না পারলে এদের দ্বারা নকল ওষুধ উৎপাদন সহজ হবে না। তারা বলছেন, ওষুধ তৈরির মূল উপাদান দুটি। একটি এপিআই, অপরটি এক্সিপিয়েন্স। এপিআই হল ওষুধের রাসায়নিক। এটি ছাড়া ওষুধ উৎপাদন সম্ভব নয়।

জাতীয় ওষুধ নীতিমালা-২০১৬ অনুযায়ী খোলাবাজারে ওষুধের কেমিক্যাল বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. একে লুৎফুল কবির বলেন, নকল মানেই তো ক্ষতিকারক। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব নকল ওষুধে মূল উপাদান থাকেই না। তাই এসব খেলে কোনো বড় ক্ষতি হয়তো সব সময় হবে না, কিন্তু রোগীরও কোনো উপকার হবে না। তবে ওষুধগুলোতে মূল উপাদান যদি স্বল্পমাত্রায় বা মানহীন অবস্থায় ব্যবহার করা হয় তাহলে তা রোগীর জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।

এদিকে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আবদুল বাতেন বলেন, নকল ওষুধ পাচার চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে একাধিক কোম্পানির নাম ও মোড়ক হুবহু নকল করে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ওষুধ বাজারজাত করছে। এসব ওষুধের গায়ে এরা সেটে দেয় বিভিন্ন পরিচিত কোম্পানির লেবেল, যা দেখে বোঝার উপায় থাকে না কোনটা আসল আর কোনটা নকল।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ওষুধের কাঁচামাল অবৈধভাবে বিক্রি বন্ধ হলে নকল ওষুধ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেত। তবে কেমিক্যাল মার্কেটে নজরদারি করার মতো স্পেশাল কোনো সংস্থা নেই আমাদের দেশে।

Bootstrap Image Preview