Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগ নিয়ে মুখ খুললেন জামায়াত সেক্রেটারি

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৫:৩১ PM
আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ০৫:৩১ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


দল বিলুপ্ত এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভুমিকার জন্য জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক।

আজ শুক্রবার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সহকারী কাউসার হামিদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। জামায়াতের পক্ষ থেকে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে দলের সেক্রেটারি জেনারেল একটি বিবৃতি দিয়েছেন।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের সরে যাওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ ব্যাপরে জবাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ আমরা দীর্ঘদিন একইসঙ্গে এই সংগঠনে কাজ করেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতা ছিলেন। তার অতীতের সব অবদান আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি’।

আজ শুক্রবার বিকালে এক বিবৃতিতে শফিকুর রহমান বলেন, ‘তার পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। পদত্যাগ করা যেকোনও সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি, তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন’।

এ ব্যাপারে বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জামায়াতের আমীর মকবুল আহমদকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তিনি। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকাকেই সামনে এনেছেন।

পদত্যাগপত্রে রাজ্জাক বলেছেন, তিনি দুই দশক ধরে দলের শীর্ষ নেতাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, জামায়াত যেন একাত্তরের ভূমিকার জন্য জাতির কাছ ক্ষমা চায়। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পরও জামায়াত সেটি করেনি।

পদত্যাগপত্রে ব্যারিস্টার রাজ্জাক উল্লেখ করেছেন, স্বাধীনতায় বিরোধিতার জন্য তিনি জামায়াতকে বিলুপ্ত করে দেয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন দলীয় ফোরামে। কিন্তু জামায়াত সেটি করেনি।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক মনে করেন, দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও দলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মাধ্যমে দেশের জন্য অসংখ্য সৎ, দক্ষ ও কর্মনিষ্ঠ নাগরিক তৈরিতে জামায়াতে ইসলামী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। যে কারণে দলের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের প্রতি দায়িত্বও পালন করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জামায়াতের আমিরকে পাঠানো চিঠিতে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, জামায়াত দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌত্বকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়েছে। দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডেও জামায়াত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত নয়। বরং ষাটের দশকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আশির দশকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও করেছে দলটি। কিন্তু একাত্তরে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দলটির অবস্থান তাদের সব অর্জন ম্লান করে দিয়েছে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘নেতিবাচক ভূমিকা’র কারণে জামায়াতে ইসলামীর ক্ষমা চাওয়া ‘জরুরি কর্তব্য’ বলে মনে করেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তিনি চিঠিতে বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপলব্ধি ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে নিস্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেনি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজও দলের নেতৃবৃন্দ ৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে পারেনি। এমনকি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে দলের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেনি। তাই অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে ভুল স্বীকার করে, জাতির কাছে নিজেদের সেই সময়কার নেতাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে পরিষ্কার অবস্থান নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।’

কোনো রাজনৈতিক দল কোনো পরিস্থিতিতে ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেও তাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে, সেই সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান বজায় রাখাকে অগ্রহণযোগ্য ও আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক লিখেছেন, ‘আমি বিগত প্রায় দুই দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে ৭১-এ দলের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত এবং ওই সময়ে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’

বিভিন্ন সময়ে দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে ব্যারিস্টার রাজ্জাক এ বিষয়ে যেসব বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তার বিবরণও দিয়েছেন। এসময় সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসেও জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে তার মতামত চাইলে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে জামায়াতকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি। কিন্তু এ বিষয়ে তার তিন দশকের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক চিঠিতে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে দলের গ্রহণযোগ্য বক্তব্য না দেওয়ায় এবং ক্ষমতা না চাওয়ায় গোটা জামায়াতকেই দায়ভার নিতে হচ্ছে। এমনকি যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেননি, তাদেরও এই দায়ভার নিতে হচ্ছে। ভবিষ্যতের অনাগত প্রজন্মের যারা জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হবেন, তাদের এই দায়ভার বহন করতে হবে সতর্ক করে দেন তিনি। এর মাধ্যমে জামায়াত জনগণ, গণরাজনীতি এবং দেশবিমুখ দলে পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য তার।

মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ ছাড়াও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের সংস্কার আনতে ব্যর্থ হওয়াকেও নিজের দল থেকে সরে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে মুসলিম বিশ্বে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কয়েকটি দেশে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে গঠিত মধ্যমপন্থি দলগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এই পরিবর্তনের বাতাস যদিও এখন পর্যন্ত ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের গায়ে লাগেনি, কিন্তু সময় এসেছে আমাদের পূর্বপুরুষের তৈরি ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণায় কোনো পরিবর্তন আনা যায় কি না, তা নিয়ে নতুন প্রজন্মের গভীরভাবে চিন্তা করার। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বহুদিন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যাবস্থা চালু থাকলেও আমরা এখন আবার বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যাবস্থার দিকে ফিরে যাচ্ছি। এই নতুন বাস্তবতায় নতুন প্রজন্মকে নতুন চিন্তা নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে।

জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দলের সংস্কারের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন বলে জানান ব্যারিস্টার রাজ্জাক। দলের কাঠামোগত সংস্কার, নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ ও অভ্যন্তরীণ সংস্কার বিষয়ে একাধিকবার মৌখিক ও লিখিত আকারে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন বলেও জানান। তিনি বলেন, ‘সবশেষ বিশ্ব পরিস্থিতি ও মুসলিম দেশগুলোর উত্থান-পতনের আলোকে জামায়াতের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে আমূল পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছি। প্রতিবারের মতো কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’

বাংলাদেশের তরুণরা সচেতন, শিক্ষিত ও আলোকিত এবং চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলে মনে করেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। এই তরুণদের একটি বড় অংশ জামায়াতের সঙ্গে থাকলেও বৃহত্তর যুবসমাজকে নেতৃত্ব দিতে জামায়াত সফলতা অর্জন করতে পারেনি বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। এ পরিস্থিতিতে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ইসলামী মূল্যরোধের ভিত্তিতে জামায়াত নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি বলে মূল্যায়ন তার।

এর আগেও অনেকবার দল থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছেন উল্লেখ করে জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘এই ভেবে নিজেকে বিরত রেখেছি যে যদি আমি আভ্যন্তরীণ সংস্কার করতে পারি এবং ৭১-এর ভূমিকার জন্য জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে তা হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। কিন্তু জানুয়ারি মাসে জামায়াতের সর্বশেষ পদক্ষেপ আমাকে হতাশ করেছে। তাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হলাম।’

পদত্যাগের পর নিজের পেশায় আত্মনিয়োগ করবেন উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে একটি সমৃদ্ধ ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাই কেবল নয়, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল জামায়াতে ইসলামী। এরই মধ্যে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় দলের একাধিক শীর্ষ নেতা আদালতে বিচারের মুখোমুখি হয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছেন। দলটির সাবেক আমিরসহ পাঁচ শীর্ষ নেতার ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। আদালত এসব মামলার রায় ঘোষণার সময় জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

এদিকে, ২০০৯ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি ইসলামপন্থী সংগঠনের ২৫ নেতার এক আবেদনের পর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সেই রুলের শুনানি শেষে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। নির্বাচন কমিশন থেকেও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। নিবন্ধন না থাকায় দল হিসেবে জামায়াত কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক হয়ে একটি সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে দলটি। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দলটির বেশ কয়েকজন নেতা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ নেন।

Bootstrap Image Preview