Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৭ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

গোপালগঞ্জে হাসপাতাল আছে সেবা নেই, রোগী আছে ডাক্তার নেই!

আরমান খান জয়, গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি:
প্রকাশিত: ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১০:১৫ PM
আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, ১০:১৫ PM

bdmorning Image Preview


চরম অব্যবস্থাপনায় চলছে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। রোগীদের পর্যাপ্ত চাপ থাকলেও নেই ডাক্তার। কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকার জন্য সরকারের কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও তা তোয়াক্কা করছেন না চিকিৎসকরা।

কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব ও অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ায় সদর হাসপাতালটি যেন অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। দালালদের খপ্পরে পরছে সাধারণ রোগীরা। ঠিক হাসপাতালের মধ্যেই বসেছে বেদে সম্প্রদায়ের তাবিজ-কবজ ও মালিশের ব্যবসা। ফলে হাসপাতালের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ ও অসহায় রোগীরা।

সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ডাক্তারের চেম্বারের সামনে উপচে পড়া রোগীর ভির। কিন্তু ভিতরে গিয়ে দেখা যায় ডাক্তার অনুপস্থিত। তার বদলে রোগী দেখছেন ইন্টারনি চিকিৎসকবৃন্দ। কিছু ডাক্তার পাওয়া গেলেও তারা শুধু রোগের বর্ণনা শুনে শুনেই লিখে দিচ্ছেন প্রেস্ক্রিপশন। বিভিন্ন টেস্ট দেওয়া থেকে শুরু করে উক্ত প্রেস্ক্রিপশনে, রোগের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব ব্যবস্থা হাসপাতালে থাকলেও রোগীদের তা করতে হয় ডাক্তারদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। যার দরুণ রোগীদেরও গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা।

টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালে এসে দেখা যায় ডাক্তার নেই, বিকালে বসবেন নিজস্ব চেম্বারে। সেখানে গিয়ে টেস্ট রিপোর্ট দেখাতে হবে। চেম্বারে রোগী দেখার ফি নুন্যতম ৫০০/৬০০ টাকা। রিপোর্ট দেখার পরে লেখা হয় ঔষধ। যা কিনা হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যেই পাওয়ার কথা, কিন্তু তাও বিধিবাম। গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে বর্তমানে প্যারাসিটামল ট্যবলেটের ও চালান আসে না বলে জানান কর্মরত ফার্মাসিস্ট। এক কথায় গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাসেবা নামে চলছে রোগীর সাথে তামাশা।

এতো গেল বহি:বিভাগের চিকিৎসা সেবা। অন্ত:বিভাগের চিত্রতো আরো ভয়ানক। অন্ত:বিভাগে গিয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়, ভর্তি রোগীদের সাথে চরম খারাপ আচরণ করেন নার্সরা। রোগীর চাপ থাকলেও এখানেও রয়েছে ডাক্তারের স্বল্পতা। সঠিক চিকিৎসার অভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ রোগীকে ভর্তি থাকতে হয় হাসপাতালে। একটু বেশী অসুস্থ বা ক্ষত থাকলে সেই রোগী ভর্তি না করে রেফার করে দেওয়া হয় খুলনা কিংবা ঢাকার কোন হাসপাতালে।

নামে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল হলেও কাজে ভিন্ন চিত্র। শুধু জেলার নয় আশেপাশের বেশ কয়েকটি জেলার রোগীরাও চিকিৎসা নিতে আসেন এই হাসপাতালে। যার দরুণ রোগীর চাপ সর্বত্রই বিরাজ করে হাসপাতালটিতে।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের আসা-যাওয়ার মেঝেতে বিছানা দিয়ে। এসময় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা হলে তাঁরা বলেন, এই শেষ বয়সে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। ডাক্তারের দেখাও পাওয়া যায় না। আমাদের এই কষ্ট কি সরকারের চোখে পড়ে না?

কর্তব্যরত নার্সদেও সাথে কথা হলে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান।

সদরের পোদ্দারচর থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান জানান, আমি মাথার সমস্যার জন্য হাসপাতালে এসে ভর্তি হই। তিন দিন ফ্লোরে থাকার পরে আমাকে কেবিনে সিট দেয়, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমাদের যে ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা আছে তার কিছুই এখানে আমরা পাচ্ছি না। হাসপাতাল ঠিকই আছে নেই শুধু সেবাটাই। চরম অসুস্থতার সময়ও এখানে চিকিৎসক আর সেবিকার সন্ধান পাওয়া যায় না।

আরেক মুক্তিযোদ্ধা কাজী আতায়ার জানান, আমি গত কয়েকদিন যাবৎ পায়ে ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি দিনে সর্বচ্চ ১ বার ডাক্তার আসেন নার্সদের তো কোন দেখাই নাই এখানে চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ঢাকার হাসপাতালে। শুধু আমি না এভাবে প্রতিদিনই সেবা বঞ্চিত রোগীদের অন্যত্র চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে।

এ সময় মুক্তিযোদ্ধা শাহিদ মিয়ার স্ত্রী রিনা বগম জানান, আমি ৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি, এই ৫ দিনে ডাক্তার পাইছি মাএ ৩ বার। শারিরিক অবস্থার কোন উন্নতি নে। আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছি। সেখানে সাধারণ মানুষ কি অবস্থা হতে পারে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আরেক রোগী বলেন, 'সক্কালে আইছি বুকের ব্যথার ডাক্তর দেখাইতে, কিন্তু এহন শুনতাছি কোনো ডাক্তার নাই। আমরা গরীব মানুষ কোনে জামু ডাক্তার দেহাইতে। এখানে একজন আপা বলতেছে ডাক্তার স্যার ওনার চেম্বারে আছে চেম্বারে গিয়ে দেখাই আসেন। কিন্তু প্রাইভেট ভাবে গিয়া ডাক্তার দেখাইতে অনেক টাহা লাগে, এত টাহা পামু কই?'

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সব মিলিয়ে এ হাসপাতালে ২৫৬ জন জনবল রয়েছে। এদের মধ্যে ৬১ জন ডাক্তারের মধ্যে রয়েছেন ৩৬ জন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, অধিকাংশ ডাক্তারই কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন না। তারা ঢাকা ও অন্যান্য স্থান থেকে সপ্তাহে ১/২ দিন এসে ডিউটি করেন। অভিযোগ রয়েছে কৌশল হিসেবে একজন ডাক্তার ২৪ ঘণ্টা উপস্থিত থেকে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা ডিউটি হিসেবে ৩ দিনের ডিউটি দেখান। এভাবে একটানা দুইদিন উপস্থিত থাকলে তার ৬ দিনের ডিউটি হয়ে যায়।

এ অনিয়মের সত্যতা স্বীকার করে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. অসিত কুমার মল্লিক, আপনারা সাংবাদিকরা যে অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন সে সম্পর্কে আমিও অবগত আছি। হাসপাতালে ৩৬ জন ডাক্তারের মধ্যে কেউ ছুটিতে, কেউ অনুপস্থিত, আবার কেউ ডেপুটেশনে আছেন।

হাসপাতালের পরিচালক প্রধান ডা. ফরিদুল ইসলাম জানান, আমাদের বিরুদ্ধে যে অনিয়ম আছে তা পুরোপুরি মিথ্যা না। আমরা জনবল সংকটে আছি, পর্যাপ্ত জনবল পেলে আমরা হাসপাতালকে পরিষ্কার পরিছন্নতায় আনতে পারবো। ডাক্তারদের অনুউপস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

Bootstrap Image Preview