সালিশিদের রায় না মানায় সুনামগঞ্জে একটি সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের একঘরে করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলার দোয়ারাবাজারের মান্নারগাঁও ইউনিয়নের মান্নারগাঁও গ্রামের পূর্বপাড়ার এলাকার প্রভাবশালী সালিশিদের রোষানলে পড়ে ১০ শ্রেণিতে পড়ুয়া স্কুলছাত্রসহ একই পরিবারের ৬ সদস্যরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী উপজেলার মান্নারগাঁও পূর্বপাড়ার অনিল চন্দ্র দান ইতিমধ্যে সালিশিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিয়োগ দিলেও পুলিশ কার্যত সময়ক্ষেপণ করে যাচ্ছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও একঘরে হওয়া পরিবারের লোকজন জানান, উপজেলার মান্নারগাঁও পূর্বপাড়ার অনিল চন্দ্র দাস ও তার সহোদর ছোট ভাই নিধু রঞ্জন দাসের মধ্যে জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে গত প্রায় মাস চারেক পূর্বে বাড়িতে পাড়ার লোকজন সালিশ বৈঠকে বসেন।
সালিশ চলাকালে অনিল ও নিধুর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মারামারি হওয়ার এক পর্যায়ে নিধু আহত হন। পরবর্তীতে মারামারির ঘটনায় ফের সালিশ বৈঠকে অনিল দাসের পরিবারকে ১০ হাজার জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে অনিলের স্কুল পড়ুয়া ছেলে অনিক দাসের ওপর চাচা নিধু দাসকে হামলার দায় চাপিয়ে তার মাথা ন্যাড়া করার রায় দেওয়া হয়।
অনিল চন্দ্র দাস বুধবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বলেন, স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে অনিকের মাথ্যা ন্যাড়া করা, ১০ হাজার টাকা জরিমানার রায় প্রদান করেন সালিশিগণ। আমি জরিমানার টাকা নিয়ে সালিশিদের নিকট গিয়ে কাকুতি মিনতি করে বলেছি, আমার ছেলে যেহেতু স্কুলে লেখাপড়া করে তাই তার মাথা ন্যাড়া করলে হয়ত তাকে আত্বহত্যার প্ররোচনায় বাধ্য করা হবে, তাই মাথ্যা ন্যাড়ার বিষয়টি করার বাদ দিতে আমি বাবা হিসেবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও সালিসীদের তাতে মন টলেনি।
অনিলের স্ত্রী রত্না রানী দাস জানান, গ্রাম্য সালিসে অনিকের মাথা ন্যাড়া না করায় গত চারমাস ধরে আমাদের পরিবারটিকে একঘরে করে রাখা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রভাবশালী সালিশিগণের ইশারায় গ্রামের অন্য কোন পরিবার আমাদের পরিবারের কোন সদস্যর সাথে মেলামেশা, যাতায়াত কিংবা চলাফেরা করছে না এমনকি গ্রামের মাঠে গবাধী পশু চড়াতেও নিষেধ করা হয়েছে। অনিকের মায়ের প্রশ্ন- আমার ছেলে অনিক তার চাচার ওপর হামলাই করেনি তাহলে কেন আমাদের একঘরে রাখা হল?
গ্রামবাসী জানান, সালিশি হিসাবে নেতৃত্বে দিয়েছেন মান্নারগাঁও পূর্বপাড়ার অবনি মোহন দাস ওরফে পাখি দাস, রবীন্দ্র দাস, ধিরু দাস, ভূপ্রেন্দ্র দাস, বকুল দাস, পুতুল দাস, দেবল দাস, রনজিৎ দাস, চিনু দাস, বিলম্ভ দাস, মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দীপক দাসসহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
গ্রামের পশ্চিমপাড়ার প্রদীপ দাস সালিশের রায়ে মাথা ন্যাড়া করার বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সালিশকারীরা কোথাও ফোন করে একজন পণ্ডিতের কাছ থেকে গুরুজনদের আঘাত করার শাস্তি হিসেবে এই মাথা ন্যাড়া করার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। কিন্তু অনিকের পরিবার সেটি না মানায় তাদের একঘরে করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। আমাদেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে তাদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে।
গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা নিরঞ্জন দাস জানান, সম্প্রতি অনিলের বাড়িতে গুরুদেব আসার পর আমাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, কিন্তু আমরা কয়েকজন ওই বাড়িতে যেতে চাইলে পথে ওই পাড়ার কিছু লোকজন আমাদের তাদের বাধা দেন।
এ বিষয়ে সালিশি অবনি মোহন দাস ওরফে পাখি দাস বলেন, যেহেতু অনিলের ছেলে অপরাধ করেছে তাই তার মাথান্যাড়া করলে দেহশুদ্ধি হবে, এটা শাস্ত্রের কথা, আমাদের না।
একঘরে রাখার বিষয়ে পাল্টা প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টার এক পর্যায়ে বলেন, ‘আমরা নই, অনিলই পঞ্চায়েতের সঙ্গে থাকতে চায় না। সে যখন শান্ত্র মানবে না তখন আমরা বলেছি, তুমি তোমার মতো চলো, আমরা আমাদের মতো চলব।'
স্থানীয় ইউপি সদস্য দীপক দাস সালিশে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করলেও তিনি অনিলের পরিবারকে একঘরে করে রাখা বা মাথা ন্যাড়া করার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবু হেনা আজিজ বুধবার বিকেলে বলেন, একঘরে করে রাখার বিষয়টি অমানবিক ও বেআইনি কাজ।
দোয়ারাবাজার থানার ওসি সুশীল রঞ্জন দাসের নিকট বুধবার বিকেলে এ বিষয়ে বলেন, অভিযোগ পেয়ে তদন্তে পাঠানোর পর থানার এসআই অভিযোগের বেশ কিছু সত্যতা পেয়েছেন, আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছি।